নিজস্ব প্রতিবেদক; সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তবে সিলেট শহর থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। এসব এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে আরও ১০ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন করে রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ ১০ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, এ সময়ে টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে সুনামগঞ্জ ও সিলেটে বন্যায় দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কিশোরগঞ্জে হাওরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোনায়ও বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী নেমেছে।
সুনামগঞ্জ ও সিলেটে দুজনের মৃত্যু: এদিকে সুনামগঞ্জ ও সিলেটে এবারের বন্যায় এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ দুইজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেছেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সুনামগঞ্জের অবস্থা একই রকম রয়েছে, ১০ জেলার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দেশে প্লাবিত ১২ জেলার মধ্যে ৭০ উপজেলার ৪০ লাখ পানিবন্দি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে উদ্ধার তৎপরতা চলছে বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
গতকাল সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এনামুর রহমান। তিনি বলেন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে ভাটির দিকে দক্ষিণাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে বন্যায় যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী, সে পানির টানে ভেসে গেছে। আরেকজন বয়স্ক ব্যক্তি বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন। তবে তাদের নাম-পরিচয় বিস্তারিতভাবে জানাননি এনামুর রহমান। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে ৭৫ হাজার এবং সিলেটের ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। একই সঙ্গে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বন্যার্তদের জন্য সরকার এ পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা করে মোট দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
নতুন করে রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ ১০ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেসব জেলায় ১০ লাখ টাকা ও শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে বলে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশে তৃতীয় দফা এই বন্যায় ৪০ লাখ পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী কোস্টগার্ড ও অন্যান্য সংস্থা কাজ করছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের স্থানগুলোয় মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারেও বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। একই সময়ে তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার কাছাকাছি অথবা উপরে অবস্থান করতে পারে।
কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, সুরমা, কুশিয়ারা, ঘাঘট এবং সোমেশ্বরী নদীর ১৮ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। তবে সারিগোয়াইন, খোয়াই, পুরাতন সুরমা ও কংশ নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। যেসব নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় দুই পয়েন্টের পানি।
বৃষ্টিপাতের বিষয়ে কেন্দ্র বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে সিলেটের জাফলংয়ে ৩১৭ মিলিমিটার। এছাড়া সিলেট পয়েন্টে ৩১৫, সিলেটের লালাখালে ৩১১, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণবাগ পয়েন্টে ২০৫, লাটুতে ১৭৫, কানাইঘাটে ১১০, জকিগঞ্জে ১৯৩, শেওলায় ১১৫ এবং সুনামগঞ্জে ১২৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: উজানের পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানান। হাওরের ওপর প্রবাহিত বিভিন্ন নদ-নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় তিন ফুট বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে গতকাল রোববার থেকে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ছে জেলার হাওর উপজেলা হিসেবে পরিচিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, তাড়াইল ও নিকলী উপজেলার মানুষ। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলাগুলোর কয়েকশ বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। গবাদিপশুসহ মালামাল সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন কেউ কেউ।
ইটনা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাফিসা আক্তার বলেন, এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। সেখানকার লোকজন ইটনা সদরে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সরকারি কলেজসহ অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। নিকলী উপজেলার উপজেলার কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ছাতিরচর, সিংপুর, দামপাড়া ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ইউএনও মো. আবু হাসান জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, যেসব এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে, সেখানকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ১৪০ টন চাল ও নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বন্যার্তদের উদ্ধারে নেত্রকোনায় সেনাবাহিনী: সিলেট ও সুনামগঞ্জের পর বন্যার্তদের উদ্ধারে নেত্রকোনায়ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। জেলার হাওর উপজেলা খালিয়াজুড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনীর ১৩০ জনের একটি দল এসেছে। তারা মদন উপজেলা থেকে আমাদের এখানে উদ্ধার অভিযান করবেন। তারা মদন সরকারি কলেজেই থাকবেন।
সুনামগঞ্জ ও সিলেটের পাশের হাওরাঞ্চলের জেলা নেত্রকোনায়ও প্রতিদিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিই এর মধ্যে প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে হাওর সংলগ্ন খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দা ও মোহনগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জেলার মোট ছয়টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন এ নাগাদ বানভাসি মানুষের জন্য ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। ৪৭৩ হেক্টর জমির আউশ ও সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই জেলা প্রশাসনের আহ্বানে খালিয়াজুড়ি উপজেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।