নিজস্ব প্রতিবেদক:দেশে সাক্ষরতার হার বাড়াতে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা এক অসামান্য অবদান রেখেছে। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার কল্যাণে একসময় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু আর্থ-সামাজিক নানা সংকটের বেড়াজালে বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা। এসক সময় গ্রামের সব শ্রেণির পরিবারের শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিলেও এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কিন্ডারগার্টেন সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে প্রত্যন্ত গ্রামেও। আবার শহরে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে গৃহকর্মী, রিকশা চালকসহ নানা শ্রমজীবী মানুষের ছেলেমেয়েরা পড়ে। পরিবারের আর্থিক অনটন থাকায় এসব শিশুকে নিয়মিত স্কুলে ধরে রাখা যায় না। আর সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতার কারণে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চান না। সবমিলিয়ে এক ধরনের আর্থ-সামাজিক সংকট অতিক্রম করছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
এমন চিত্র উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা ও নাগরিক সংলাপে। গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল এবং গাইবান্ধা, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলায় অনুষ্ঠিত নাগরিক সংলাপের ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ২০ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করেছে সিপিডি। এই সুপারিশমালা নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন ও জাতীয় পর্যায়ে স্থানীয় অংশীজনদের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার সংকটগুলো তুলে ধরার লক্ষ্যে গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শিরীন আখতার। অনুষ্ঠানে প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এছাড়া বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের কর্মসূচি প্রধান সমীর রঞ্জন নাথ, বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সৈয়দ রাশেদ আল জায়েদ যশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রগ্রাম ম্যানেজার নাদিয়া রশিদ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের কনস্যুলার জুরেট মারভিলে, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
মূলত সিপিডি উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলা গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীর ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০৮ জনের ওপর জরিপ করে এসব তথ্য জানিয়েছে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জরিপ করা ৩০টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪টিতে পাঁচটির কম শ্রেণিকক্ষ রয়েছে, যা প্রয়োজনের চেয়ে কম। আর শিক্ষকের গড় সংখ্যা ছিল ছয়। সেখানকার শিক্ষার্থীর বিবেচনায় গড়ে ২৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক আছেন, যা জাতীয় হারের চেয়েও কম। কিন্তু যখন কোনো শিক্ষক বদলি হন বা অনুপস্থিত থাকেন, তখন ক্লাস নিতে সমস্যা হয়। অন্যদিকে বিদ্যালয়গুলোয় অফিস সহায়ক না থাকায় প্রধান শিক্ষকের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এর ফলে তিনি পাঠদান ও শিক্ষক-শির্ক্ষাীদের ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না। জরিপে আরও দেখা যায়, বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় স্কুলে ২৯ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া গবেষণা জরিপে ৩০টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪টি বিদ্যালয়ে পাঁচটির কম শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে আটটি বিদ্যালয়ে পাঁচটির বেশি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে এবং বাকি আটটি বিদ্যালয়ে পাঁচটি করে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে।
তৌফিকুল ইসলাম খান উল্লেখ করেন, সিপিডি উত্তরের তিন জেলায় প্রাথমিক শিক্ষার ওপরে তিনটি সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা করে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত পাঁচ বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বাজেট কমানো হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয়েছে ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশে। এছাড়া মোট সরকারি ব্যয়ের অনুপাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি। এ বৃহৎ কর্মক্ষম মানুষের সমন্বয়ে ও বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমাদের অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখন আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করতে হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, এটা অনেকেই ভাবেন যে শহরাঞ্চলে যারা থাকেন তারাই মেধাবী হবেন এবং উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন, আর যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকবেন তারা বঞ্চিত হবেন, এটা তো ঠিক নয়। এটা ভুল ধারণা। আমাদের সব জায়গাতেই পৌঁছাতে হবে। এটা অনেকেই ভাবেন যে, সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় বা শিক্ষা খাতে বাজেটে কম বরাদ্দ রাখছে, কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। আমাদের সব জায়গাতেই হিসাব করে বরাদ্দ দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন আসছে। এটা নিয়ে অনেক বড় বড় ব্যক্তি কাজ করছেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিন্তু অনেক কাজ হয়েছে। পেছন ফিরে তাকালেই আপনারা তা দেখতে পাবেন। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। অর্থনৈতিক পরিবর্তন আমাদের হয়েছে। এখন আমাদের ‘মোটিভেটেড’ হওয়া দরকার। আমাদের একে অন্যকে সম্মান করতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। এটার জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
সšে§লনে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের ওপর গুরুত্বারোপ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, উন্নত মানের শিক্ষক দরকার। শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে চাকরির সর্বশেষ পছন্দ হলে এগোনো যাবে না। শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রথম বা দ্বিতীয় পছন্দ হওয়া দরকার। আর সেটি নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকতা পেশার জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে হয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই উন্নয়নের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে বৈষম্য। সমাজে যেমন বেড়েছে আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য, তেমনি বেড়েছে শিক্ষার বৈষম্য। প্রাথমিকে শিক্ষার অদক্ষতার কারণে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারছি না। আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগ করতে পারছি না। এখন আমাদের প্রয়োজন শুধু শিক্ষার প্রসার নয়, মানসম্মত শিক্ষার প্রসার।’
উš§ুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে উত্তরের তিন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুধীজনরা তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তারা উল্লেখ করেন, চরাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলে যেসব শিক্ষকের পদায়ন হয়, তারা সেখানে যেতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে বদলি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করানো হয় এবং যে ব্যক্তি চাকরি পেয়েছেন, তিনি কেবল বেতন তোলার সময় স্কুলে গিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে বলে তারা। কোচিং স্টোরগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তরায় বলে অনেকে উল্লেখ করেন। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষই তাদের ছেলেমেয়েদের নিজ স্কুলে ভর্তি না করিয়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও কোচিং সেন্টারে পাঠাচ্ছেন বলে পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। সংলাপে শিক্ষকদের নৈতিকতার বিষয়টি যেমন উঠে আসে, তেমনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নানা বঞ্চনার বিষয়টিও উঠে আসে। এক শিক্ষক উল্লেখ করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের বেতন গ্রেড একজন সরকারি গাড়িচালকের বেতন গ্রেডের নিচে। এমনকি একজন ৩৮ বছর চাকরি করার পরও পদোন্নতি পান না। এই বঞ্চনা দূর করার পরামর্শ দেন তারা। পর্যবেক্ষণে আরও উঠে আসে যে, শিক্ষার্থীদের যে উপবৃত্তি দেয়া হয়, তা সঠিক শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে না। এ অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, তা অনুসন্ধান করার পরামর্শ দেন শিক্ষকরা। এছাড়া বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান করার সময়সীমা কমিয়ে আনা ও মিড ডে মিল চালু করার পরামর্শ দেয়া হয়।