আর্থিক খাতের সংস্কার ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

মো. মাঈন উদ্দীন: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে দুটি লড়াই চলছে। কভিড-পরবর্তী সময়ের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলা। গত পাঁচ দশকে অর্থনীতির চাকা নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যখন একটি মজবুত ভিতের কাঠামো তৈরির দিকে এগোচ্ছিল তখনই দেখা দিল কভিড-১৯ এর ভয়াবহতা। কভিড মহামারির তাণ্ডবের ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতির চাকা যখনই একটু ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল তখনই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব এসব তাণ্ডব মহামারির সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। এসব বৈশ্বিক সমস্যা থেকে উত্তরণ-নির্ভর করছে কোন দেশ কীভাবে ও কতটুকু দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করছে তার ওপর। তাছাড়া প্রতিটি দেশের শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক শক্তি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা ও পরিস্থিতির মোকাবিলার সক্ষমতার ওপর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আমাদের অর্থনীতিতে কতগুলো সমস্যা আগে থেকেই চলে আসছে। আমাদের ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব, অর্থের অপচয়, আয় ও সম্পদের বৈষম্য, খেলাপি ঋণ, কৃষির আধুনিকায়ন ও কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থার অভাব ও আবহাওয়া, জলবায়ুজনিত সমস্যা ইত্যাদি। এজন্যই সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধিসহ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে জোর দেয়া উচিত। ইতোমধ্যে, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসতে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।  দরিদ্র, মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণির মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা। দেশের অধিকাংশ মানুষ আত্মরক্ষার ঝুঁকিতে রয়েছে। মানুষের সঞ্চয় ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও তলানিতে নেমে এসেছে। গত আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় মাত্র ৮ লাখ টাকার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনি¤œ। অথচ গত বছর (২০২১) আগস্টে নিট বিক্রি হয় ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। দেশের সার্বিক ব্যাংকিং লেনদেনও মন্দা নেমে এসেছে। জুলাই ২০২২ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, এমআইসিআর চেক লেনদেন, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও ই-কমার্স সর্বক্ষেত্রেই আগের মাসের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। এমআইসিআর ও নন- এমআইসিআর চেকের লেনদেন অঙ্ক ২৭.৬০ শতাংশ কমে ২০ হাজার ১৫২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। একই সময়ে লেনদেনের সংখ্যা কমেছে ২৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারে (ইএফটি) ব্যাংক লেনদেন কমেছে ১০.৭৬ শতাংশ। আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) এ লেনদেন কমেছে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। ব্যাংক খাতের লেনদেনের এ অবনতিশীল অবস্থা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের মন্দার লক্ষণ। এদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাংক ঋণে সুদের হার সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখে আবারও নীতিসুদ হার বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেপোর সুদ ২৫ শতাংশ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। রেপোর পাশাপাশি বিশেষ রেপোর মাধ্যমেও বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়। এখানে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশের অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে রয়েছে। জুলাই ২০২২-এ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরো আগস্ট ২০২২-এর মূল্যস্ফীতি প্রকাশ না করলেও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্বেই উদ্বেগের কারণ হলেও সরকারকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন যাতে বিপর্যয় নেমে না আসে সেজন্যই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিত্যপণ্যসহ প্রায় ১১টি সেবার মূল্য এক বছরের ব্যবধানে সর্বনি¤œ ৭ থেকে ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্য ও সেবার মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো মানুষের আয় মোটেও বাড়েনি। মানুষ জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে কোনো রকম আপস করে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। আমাদের কৃষি উৎপাদনও কাক্সিক্ষত মানের হচ্ছে না। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম বড় একটি আশঙ্কার খবর দিয়েছে। সমীক্ষায় বিশ্বের ১২ জন সেরা অর্থনীতিবিদের বরাতে বলা হয়েছে ২০২৩ সালে আরও একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। মন্দা মোকাবিলায় প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে  হবে। এদিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেÑসংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছে। খাত তিনটি হলোÑদুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাত, বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হ্রাস, ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত নগরায়ন। এই তিন চ্যালেঞ্জ উত্তরণ না হলে গত পাঁচ দশকে যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। মাথাপিছু আয়ের যে বৃদ্ধি তাও কমে যাবে। ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম চেঞ্জিং অব ফেব্রিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ওই তিন খাত সংস্কার না হলে ২০৩৫ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর মোটামুটি ধরনের সংস্কার হলে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ ও কার্যকর সংস্কার হলো ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এতে উন্নয়ন আরও তরান্বিত হবে ও ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদন অনেকটা বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক বটে। অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জনশক্তি ও পোশাক রপ্তানি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই দুটি খাতের উন্নয়নসহ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার সাধন করে অর্থনীতির চাকাকে টেকসই করতে হবে। যাতে যেকোনো আঘাত সহ্য করার সক্ষমতা অর্জন করা যায়। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, শুল্কহার কমানো উচিত। অর্থঋণ আদালত ২০০৩-এর সংস্কার ও খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ীদের জন্য নানা সুযোগ ও কভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার ও খেলাপি ঋণ হ্রাসকল্পে বেশ কয়েক ধরনের সার্কুলারস জারির পরও খেলাপির ঋণ আদায় বাড়ছে না। ওভার ডিও কমছে না। ঋণখেলাপিরা নানা সুবিধা পেয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ছে না। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা বাংলাদেশের এযাবৎকালের সর্Ÿোচ্চ ঋণ। অথচ ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আমাদের দুর্বল শাসন কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার ফল। ব্যাংকিং খাতের নানা কেলেঙ্কারির ঘটনার পেছনে রয়েছে দুর্বল ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার চর্চা ও যথাযথ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি। একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ব্যাংকিং কমিশন অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির প্রকৃত অন্তর্নিহিত সমস্যা উদঘাটন এবং সমাধানে ভূমিকা পালন করতে পারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামাল ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বললেও তার কোনো আলামত আর দেখা যায়নি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের চলমান সংকটাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা উচিত। স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করে আইনগত ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আশির দশকে বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার শুরু হয়। পরে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০০৩, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার ও মুদ্রানীতি প্রণয়নের অনুমোদন পায়।  বিশ্বব্যাংক ও অর্থনীতিবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে অর্থনীতিকে টেকসই কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর যুগোপযোগী সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

main706@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০