আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া বিনিয়োগ নির্দেশনাই কি পতনের কারণ?

মো. আসাদুজ্জামান নূর: সপ্তাহের ব্যবধানে ফের নিন্মমুখী দেশের পুঁজিবাজার। সর্বশেষ সপ্তাহে মূল্যসূচক ও লেনদেন দু-ই কমেছে। প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স সাত হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। সপ্তাহজুড়ে ১৫ খাতে দর পতনের বিপরীতে পাঁচটিতে রিটার্ন পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময় ওষুধ ও রসায়ন খাতে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে।

পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর শুরু থেকে ঊর্ধ্বমুখী থাকা পুঁজিবাজারে তিন সপ্তাহ ধরে মুনাফা গ্রহণ চলছে। এ সময় বাজারের ওঠানামায় অনেকে ঝুঁকি এড়াতে শেয়ার বিক্রি করেছেন। এছাড়া ডিসেম্বর ক্লোজিং কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ঘোষণার দিকে চেয়ে রয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ভালো অবস্থানে থাকা কোম্পানিগুলোয় নতুন বিনিয়োগের সুযোগ নিতে বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। যার কারণে কিছুটা ‘সাইড লাইনে’ রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা, যা নেতিবাচক দিকে ঠেলে দিয়েছে পুঁজিবাজারকে।

তবে সদ্যবিদায়ী সপ্তাহে পুঁজিবাজারের পতনের পেছনে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ও রিপোর্টিং-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সার্কুলার বেশ প্রভাব ফেলেছে বলে আলোচনা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিয়ে ওই নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনায় শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বাজার মূল্যে নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। যদিও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা হোক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা নিয়ে বাজার বিশ্লেষকরা ওই দিনই মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশনাটিকে ভালো বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্দেশনাটির ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে অন্যান্য বিশ্লেষকদের বেশির ভাগ বলেছিলেন, নির্দেশনাটি নেতিবাচক।

নির্দেশনা জারির পরের দিন বুধবার শেয়ারবাজারে মিশ্র প্রবণতায় লেনদেন হয়। ডিএসইর সব সূচক প্রথমভাগে বেশ ইতিবাচক থাকলেও শেষদিকে নেতিবাচক প্রবণতায় মোড় নেয়। দিন শেষে সূচক কোনো রকমে ইতিবাচক রাখা হলেও বেশিরভাগ সিকিউরিটিজের দর পতন দেখা যায়।

এর পরের দিন বড় পতন দেখা দেয়। এদিন লেনদেনের প্রায় ৭০ শতাংশ সিকিউরিটিজ ছিল পতন প্রবণতায়। ডিএসইর ২০ খাতের মধ্যে ওইদিন দুই থেকে তিনটি খাত কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও সিংহভাগই অন্ধকারে ডুবে যায়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক ভর করে।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা বাজারের জন্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের ক্রয়মূল্যে গণনা করার দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি ছিল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইনভেস্টমেন্ট এক্সপোজার বা বিনিয়োগ গণনা বাজার-মূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনায়ও বিনিয়োগ গণনা ক্রয়মূল্যের পরিবর্তে বাজারমূল্যে ধরার কথা বলা হয়েছে। সেসঙ্গে বন্ডের মতো ডেভ সিকিউরিটিজ, ডিবেঞ্চার, মিউচুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগ গণনায় অন্তর্ভুক্ত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্রয়ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়েছে বলে দাবি পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের।

গত সপ্তাহে ডিএসইতে গড়ে দৈনিক এক হাজার ১৯৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে, যা আগের সপ্তাহে ছিল এক হাজার ৩২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে ১৩০ কোটি ১৩ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সপ্তাহজুড়ে মোট লেনদেন হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ছয় হাজার ৬১৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট লেনদেন কমেছে ৬৫০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাত। মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল খাতটির দখলে। এছাড়া বিবিধ খাতে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ লেনদেনের মাধ্যমে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আর ১১ শতাংশ লেনদেন করে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। অন্য খাতের মধ্যে ট্যানারি ৯ দশমিক ৬, বস্ত্র খাত ৯ দশমিক ৪, ব্যাংক ৬ দশমিক ৯, খাদ্য ৬ দশমিক ৭ ও সাধারণ বিমা খাতে ৫ দশমকি ২ শতাংশ লেনদেন হয়েছে। বাকি খাতের লেনদেন পাঁচ শতাংশের নিচে ছিল।

সমাপ্ত সপ্তাহে ডিএসইতে ৩৮৬টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কেনাবেচা হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র ৮৭টির দাম বেড়েছে, যা লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলোর ২৩ শতাংশ। বিপরীতে ২৮০টি বা ৭৩ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর হারিয়েছে। আর দর ধরে রাখতে পেরেছে ১৯টি কোম্পানি।

খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাপ্তাহিক রিটার্নে দর কমেছে ১৫ খাতে। বিপরীতে বেড়েছে মাত্র ৫ খাতে। আলোচ্য সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি দর কমেছে সাধারণ বিমা খাতে। এ খাতে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ দর কমেছে। আর্থিক খাতে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সেবা ও আবাসন খাতে ৪ শতাংশ দর কমে তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অন্যদিকে দর বেড়েছে ট্যানারি, পাট, প্রকৌশল ও বিবিধ খাতে।

গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের সপ্তাহের চেয়ে ৯৪ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট কমেছে। আগের সপ্তাহে তা ৬২ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট বেড়েছিল। সপ্তাহের শুরুতে এই সূচকের অবস্থান ছিল সাত হাজার ৮৮ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট। সপ্তাহ শেষে তা ছয় হাজার ৯৯১ দশমিক ৩৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

গত সপ্তাহে বাজারমূলধনে শীর্ষ ৩০ কোম্পানির মূল্যসূচক ডিএস৩০ আগের সপ্তাহের চেয়ে ২৩ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট কমেছে। সূচকটি আগের সপ্তাহে ৫ দশমিক ১৫ পয়েন্ট কমেছিল। আর ইসলামী শরীয়াহ্ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত সূচক ডিএসইএস ৯ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট।

সূচক টেনে নামায় সাতটি কোম্পানি। এতে দরপতনে সূচক হ্রাস পেয়েছে ৩০ পয়েন্ট। কোম্পানিগুলো হলো-স্কয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, একমি ল্যাবরেটরিজ, রবি আজিয়াটা, ব্র্যাক ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের দর ৩ টাকা ৩০ পয়সা কমে যাওয়ায় সূচক কমেছে ৭ দশমিক ৯০ পয়েন্ট। এছাড়া বেক্সিমকো ফার্মা ৪ দশমিক ৬০ পয়েন্ট ও গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ৩ দশমিক ৯০ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে।

এদিকে আলোচিত সপ্তাহে ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) কমেছে। আগের সপ্তাহের চেয়ে পিই রেশিও কমেছে শূন্য দশমিক ১৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ১২ শতাংশ। পিই রেশিও অবস্থান করছে ১৬ দশমিক ৭০ পয়েন্টে। এর আগের সপ্তাহে এটি ছিল ১৬ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট।

খাতভিত্তিক হিসাবে পিই রেশিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, পিই রেশিও সর্বোচ্চ ব্যাংক খাতের অবস্থান করছে ৮, সিমেন্ট খাতের ২৩ দশমিক ১, সিরামিকস ৩২ দশমিক ৯,  প্রকৌশল ২২ দশমিক ৭, আর্থিক খাতে ২১ দশমিক ৮, খাদ্য খাতে ১২ দশমিক ২, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ১২ দশমিক ২, সাধারণ বিমা খাতে ১৯ দশমিক ৬, আইটি খাতে ২৬ দশমিক ১, পাট খাতে ৬৭২ দশমিক ৫, বিবিধ ১২ দশমিক ৩, মিউচুয়াল ফান্ড ৭ দশমিক ৩, কাগজ ৩৫ দশমিক ৪, ওষুধ ১৭ দশমিক ২, সেবা-আবাসন খাতে ১৯ দশমিক ৫, ট্যানারি খাতে ৫৫, টেলিকমিউনিকেশন খাতে ১৮ দশমিক ৫, বস্ত্র খাতে ১৭ দশমিক ৫ ও ভ্রমণ-অবকাশ খাতে ৫৯ দশমিক ৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০