আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পর এবার নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা বেড়ে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকায়। যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় তারল্য সংকট রয়েছে। উপরন্তু ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এছাড়া অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১৫০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর তিন মাস আগে গত মার্চ শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

তবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ছিল ৬৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে চার প্রান্তিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন)। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এর পরের প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কমেছে ৫০৬ কোটি টাকা। আর তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি এবং (এপ্রিল-জুন) অর্থাৎ শেষ প্রান্তিকে ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা ছাড়ের পরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না। গত জুন পর্যন্ত কেউ কিস্তির অর্ধেক পরিশোধ করলে তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নির্দেশনার ফলে খেলাপি ঋণ কমার কথা ছিল। কিন্তু উল্টো খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কায়সার হামিদ শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উভয় খাতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। মূলত ঋণ পরিশোধে বেশিরভাগ শিথিলতা তুলে নেয়া হয়েছে, পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় অনেকে কিস্তি পরিশোধ করেনি। তাই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত বেশ আগে থেকে খারাপ অবস্থায় পড়েছে। তবে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) এক সময়কার নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও তিন প্রতিষ্ঠান তথা বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের নানা জালিয়াতির বিষয় সামনে আসে। তহবিল সংকট চলছে এসব প্রতিষ্ঠানে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী ভূমিকা থাকা দরকার। যাদের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের এই হাল হলো, তাদের তো কোনো শাস্তি হলো না। পি কে হালদার কার লোক, এটা সবাই জানে। এ জন্য আমানতকারীদের ভালো প্রতিষ্ঠান দেখে টাকা জমা রাখতে হবে।

গত ২৭ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সভায় জানানো হয়, দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিতে খেলাপি ঋণ ৩২ শতাংশের বেশি। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশ দেয়।

এদিকে দেশের ব্যাংক খাতেও খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। গত জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ব্যাংকঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশই এখন খেলাপি। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোর অস্বাভাবিকহারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক এক প্রতিবেদনে এমনই জানিয়েছে তারা। কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে তা নির্ধারণে বিশেষ তদারকি জরুরি বলেও মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০