নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) বিলুপ্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা নিরসনে দ্রুততার সঙ্গে একটি ব্যাংকিং কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। রাজধানীর ধানমন্ডিতে গতকাল সংস্থাটির কার্যালয়ে ‘ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই মুহূর্তে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি এসব প্রস্তাব তুলে ধরে। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) রয়েছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কাজে হস্তক্ষেপ করে। এ সংস্থাটির আসলে কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটি বিলুপ্ত করে দেয়া উচিত, কারণ এ সংস্থাটির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।
এফআইডি মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সরকারের মালিকানার প্রতিনিধিত্ব করে। এসব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী নিয়োগ, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগ, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করার মতো কাজগুলো এ বিভাগ সম্পন্ন করে থাকে। বিভাগটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে এসব কাজ কারা করবেÑএমন প্রশ্নের জবাবে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ বিভাগটি একসময় ছিল না। তখন যেভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হতো, সেভাবে পরিচালিত হতে পারে। এছাড়া এসব কাজ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি পৃথক শাখা চালু করা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বব্যাংকগুলোর কাজ দেখভালের জন্য অর্থবিভাগকে দায়িত্ব নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান করতে ব্যাংক কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। সিপিডি বলেছে, চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের হাতেই সাতটি ব্যাংক। এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। একসময় ইসলামী ব্যাংক ভালো ব্যাংক ছিল। দখলের পর তাও মুমূর্ষু হয়ে গেছে। এ ছাড়া একক গ্রাহকের জন্য ঋণসীমা নীতি লঙ্ঘন করে জনতা ব্যাংক এননট্যাক্স গ্রুপকে দিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এভাবে একক গোষ্ঠী যদি এত বেশি পায়, অন্য গ্রাহকেরা কী পাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এমন না যে তাদের স্বাধীনতা নেই; তারা এটা ব্যবহার করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বরং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের কথা চিন্তা করে নীতিমালা করেছে। দুই বছর ধরে দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে। দরকার ছিল সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া। কিন্তু বিশেষ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর যাতে সুবিধা হয়, সেজন্য সুদহার বাড়ায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুততার সঙ্গে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয় সিপিডি।
সিপিডি জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজšে§র কিছু ব্যাংক মৃতপ্রায় হয়ে আছে। তাদের চলনশক্তি নেই। তাদের জনগণের করের টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তারা মরে যাক। এতে শুধু অর্থের অপচয় হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাক এসব ব্যাংক। এ ছাড়া কিছু ব্যাংকের পারফরম্যান্স খারাপ, আরেকটু ধাক্কা লাগলেই মরে যাবে। এগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে পরিচালনার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
সিপিডি বলেছে, পুরো ব্যাংক খাত চলে গেছে নিয়মনীতির বাইরে। এত দিন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক দশকের বেশি সময় ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অন্যদের মধ্যে সংস্থাটির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বক্তব্য দেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়। সিপিডি জানায়, ব্যাংকগুলোয় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। বোর্ডের সদস্য নির্বাচন করা, ব্যাংকঋণ অনুমোদন করার প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পরিপালনে দুর্বলতা রয়েছে। স্বাধীনতা খর্ব হতে হতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরোপুরি স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে। এখানে প্রশাসনের দ্বৈততা রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মধ্যে তারা একটি অলিগার্ক তৈরি করে রেখেছে। কয়েকজন মিলে পুরো ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। নীতিমালা তৈরি করছে। অনেক খেলাপি ঋণের মামলা জমে গেছে। ব্যাংক খাত দুর্বল হচ্ছে, কারণ ব্যাংকিং কোম্পানি অ্যাক্ট পরিবর্তন করা হয়। আইনের ফাঁকফোকরে অনেক ঋণ খেলাপি বের হয়ে যায়।
বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন বলে জানিয়ে সিপিডির এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, এর ফলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান তিনি। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনিক দায়িত্ব যারা পালন করেছেন, অর্থাৎ গত ১৫ বছরে গভর্নর যারা ছিলেন, তারা যেসব নীতিমালা নিয়েছেন, সেগুলো ব্যাংকিং নর্মসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। এগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে বলে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির বিষয়টির এখনও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ করার জন্য সিআইডি ৭৯ বার সময় নিয়েছে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনে আমাদের নৈতিক সমর্থন ছিল। ছাত্রদের মুক্তির মিছিলে আমরা ছিলাম। যারা আত্মত্যাগ করেছে, তাদের কাছে আমাদের এগুলো কিছুই নয়। আর্থিক খাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরি করতে হবে। ব্যাংক খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জগুলো আর্থিক খাতেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ। একইভাবে বিমা খাতও অগ্রহণযোগ্য অবস্থায় আছে। আর্থিক খাতে সুশাসনের জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক খাতগুলো বন্ধ করতে হবে।