Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 11:40 pm

আর্থিক মন্দার ছাপ পড়েছে রাজধানীতে

হামিদুর রহমান: জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে কভিডের রেশ না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী সংকট আরও প্রকট হয়েছে। অন্যদিকে টাকার মান কমায় ও ডলার রেট বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভাব পড়েছে আমদানি-রপ্তানিতে। ফলে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কৃষক, শ্রমিক এবং পেশাজীবীসহ সীমিত আয়ের মানুষ। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ও নিত্যপণ্যের দামসহ যোগাযোগ খাতে যানবাহন খাতের ভাড়াও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। 

সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে ক্রেতা সমাগম অনেকাংশই কমে গেছে। দোকানিদের কেনাবেচাও কমেছে চোখে পড়ার মতো। দোকানিদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, এখন বাজারে আগের মতো ক্রেতা আসছে না। সব ধরনের পণ্যর দাম বাড়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। আগে যারা প্রতিদিন ৫০০ টাকার বাজার করত এখন একই আইটেমের বাজার করতে ১ হাজার টাকা বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। মানুষের কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় অনেকেই এখন বাজারের আইটেম কমিয়েছে। বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম এখন আকাশচুম্বী। মানুষ এখন গরুর মাংস খাওয়া বাদ দিয়ে বলা চলে। কয়েক মাস আগেও যারা মাসে অন্তত দুই-একদিন গরুর মাংস ক্রয় করত, তারা এখন দুই মাসেও একদিন গরুও মাংস ক্রয় করছে না।

এদিকে জ্বালানি সংকটে যোগাযোগ খাতে ঢাকা সিটিসহ দেশব্যাপী সড়ক পরিবহনগুলোয় ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি খাতেই মানুষের ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ।        

রাজধানীর মালিবাগের আবুল হোটেলের কাছে নয়ন মাংস বিতানে কথা হয় মাংস বিক্রেতা রফিক মিয়ার সঙ্গে। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আগে প্রতিদিন দুই-তিনটা গরু জবাই দিতাম। এখন বিক্রি কমায় একটি গরুর জবাই দিলেও বিক্রি সম্পূর্ণ করতে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আগে যারা মাসে দুই-তিন দিন মাংস নিত এখন দুই মাসেও একবার মাংস নেয় নাÑএমন সংখ্যা অনেক।’

কারওয়ান বাজারে মাছ বিক্রেতা মাসুদ বলেন, বাজারে এখন আগের মতো ক্রেতা নেই। অনেকে মাছের দাম শুনে চলে যায়। বিক্রি অনেক কমে গেছে।      

সংশ্লিষ্টরা জানায়, কভিড সংকটে চাকরি হারিয়েছে অনেক পরিবার। নিঃস্ব হলেও এখনও অনেকের কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা যায়নি। উল্টো করোনাকালে দেশে বেকারত্ব ও দরিদ্রের সংখ্যা দুটোই বেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। এখন নতুন করে নানামুখী সংকট পড়ায় প্রাইভেট খাত ভালো নেই। জনজীবন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক খাতেও চ্যালেঞ্জ বহুগুণ বেড়ে গেছে। যাদের টাকা আছে তারাও এখন অনেক হিসাব করে চলছে। তবে বাজারে জিনিসপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের আয়ের টাকায় সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার জমানো টাকা ভেঙে সংসার চালাচ্ছে।

তারা আরও জানায়, করোনাকালে চাকরি হারানো, স্বজন হারানো মানুষের দুর্ভোগ এখনও শেষ হয়নি। কেউ চাকরি হারিয়ে কেউবা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তায় বসেছেন। মানবদেহে পুষ্টি নিশ্চিত তো দূরের কথা, অনেক পরিবার আছে যাদের ডাল-ভাত সংস্থানই কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশের দায়িত্বশীলমন্ত্রীরা এ কঠিন পরিস্থিতিতেও জনগণকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গল্প শুনাচ্ছেন। বাজারে দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন আয়ের জনগণ যেখানে পরিবার নিয়ে দু-বেলা ভাত খেয়ে জীবন বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে মাথাপিছু আয়ের গল্প শুনিয়ে কী লাভ? বাস্তবতা দেখতে হবে। এসব সংকটের পাশাপাশি নানা রকম আতঙ্কও বিরাজ করছে মানুষের মাঝে। দিন যত যাচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়গুলোও সামনে আসছে। সম্প্রতি দেশে রিজার্ভ সংকট, ব্যাংক লুট, রাজনৈতিক বিষয়সহ ব্যাংকের টাকা রাখা নিয়েও মানুষের মাঝে নানা রকম আতঙ্ক রিবাজ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে শুধু সংবাদ সম্মেলন ছাড়া কার্যকর কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। নেয়া হচ্ছে না কালোবাজারি, মজুতদারিদের ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। বর্তমানে নিত্যপণ্যের দামের এই লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির জন্য অনেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। আর এ যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে কমবেশি সব দেশেই পড়ছে। ফলে আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে অন্য দেশীয় পণ্যের দামও এখন পাগলা ঘোড়ার মতো হুহু করে ছুটছে। কিন্তু বাংলাদেশ নিত্যপণ্যের আকস্মিক ঊর্ধ্বগতি নতুন কিছু নয়। বাজারে প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ইস্যুর জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকে। একটা ইস্যু পেলেই পণ্যদ্রব্যের অবৈধ মজুত সৃষ্টি করে এবং কৃত্রিম সংকট ঘটিয়ে বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে।