নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়েছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আর্থিক হিসাবে ৭৯ কোটি ডলার ও সার্বিক ভারসাম্যে প্রায় ৩২ কোটি ডলার ঘাটতি বেড়েছে। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৯২৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। একই সময়ে সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭৫ কোটি ডলারে। সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যের এই ঘাটতি দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। মূলত বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়া, নতুন ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি ও লেনদেন ভারসাম্যে অবনতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ে লাগাম টানা গেলেও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ। কারণ এ সময়ে শুধু স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের চাপই নয়, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণও বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার একই সময়ে সরাসরি নিট বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও পুঁজিবাজারে পোর্টফলিও বিনিয়োগ কম আসছে। এতে দেশের আর্থিক হিসাব রেকর্ড ঘাটতিতে পড়েছে। যার প্রভাবে বৈদেশিক লেনদেনের সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি কমছে না, উল্টো মাসের ব্যবধানে আবার বেড়েছে। এতে দেশের রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। তাই রিজার্ভের পতন ঠেকাতে লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি কমানোর কোনো বিকল্প নেই। আর এই ঘাটতি কমাতে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়া কমিয়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত আর্থিক হিসাবে ঘাটতি হয় না। আর্থিক হিসাবে বিদেশি ঋণ ও সহায়তা, এফডিআই এবং পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্ট প্রভৃতি বিষয় থাকে। এই সূচকগুলোর প্রত্যেকটিতেই খরা যাচ্ছে।
আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৯২৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়েই চলেছে বাংলাদেশের। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্তÑ৯ মাসে আর্থিক হিসাবে ৯২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮৪৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরের প্রথন ৯ মাসে ঘাটতি ছিল ২৯২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ সময়ে বৈদেশিক ঋণ আশানুরূপ বাড়েনি। উল্টো আগের নেয়া ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম ৯ মাসে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এসেছে ৫৪৭ কোটি ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ বেশি। এ সময়ে
স্বল্পমেয়াদি কোনো ঋণ পাওয়া যায়নি, উল্টো ১৭৭ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। এছাড়া স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণও মেলেনি। উল্টো ১ হাজার ২২৪ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। এ সময়ে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা সামান্য বেড়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে যেখানে ৩৭৬ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা এসেছিল, সেখানে এবার এসেছে ৩৯৬ কোটি ডলার। এ সময়ে মোট এফডিআই কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ, তবে নিট এফডিআই ১ শতাংশের কিছু বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে, এ সময়ে নিট পোর্টফলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে, এর পরিমাণ ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
সার্বিক ভারসাম্যেও অবনতি
আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতিতে পড়ায় প্রথম ৯ মাসে সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৭৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি ছিল আরও কমÑপ্রায় ৪৪৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। তবে গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হিসাবে ৮৪৮ কোটি ডলারের বেশি ঘাটতি ছিল।
বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে
কড়াকড়িসহ নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমে আসা ও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখায় পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এতে বিদেশের সঙ্গে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল রেকর্ড ১ হাজার ৪৬৩ কোটি ডলার। তবে পণ্যে বাণিজ্যে ঘাটতি কমলেও সেবা খাতে ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। এ সময়ে সেবার খাতের ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৯৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত
আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ে ব্যবধান কমার সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে চলতি হিসাবেও উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এ সময়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৫৭৯ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ৩২৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল। সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। তবে ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।