সেলিমা খাতুন: সুস্থ জীবনের জন্য নিরাপদ পানির কোনো বিকল্প নেই, পানির অপর নাম জীবন। কারণ দূষিত পানি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায়। আর্সেনিক দূষণ পরিচ্ছন্ন জীবনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্সেনিক হলো একটি রাসায়নিক পদার্থ। ভূগর্ভে আর্সেনিকের সৃষ্টি হয়। নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ আর্সেনিক খাবার পানির সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হয় আর্সেনিক দূষণ। এ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশের সমগ্র ভূখণ্ডের ভূগর্ভস্থ পানিতেই রয়েছে আর্সেনিক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৯টি জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতেই আর্সেনিকের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে।
আর্সেনিকযুক্ত পানি দেখে বোঝা যায় না এতে আর্সেনিক রয়েছে এবং পানিতে আর্সেনিকের স্বাদ বা গন্ধ পাওয়া যায় না। সাধারণত পানিতে কিছু না কিছু পরিমাণ আর্সেনিক সবসময়ই থাকে। খাবার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.০৫ মিলিগ্রাম। এক লিটার পানিতে ০.০৫ মিলিগ্রাম মাত্রার আর্সেনিক মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতি করে না। কোনো নলকূপের পানি পরীক্ষা করে যদি দেখা যায়, ওই মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ আর্সেনিক রয়েছে তাহলে সেই নলকূপের পানি খাওয়া ও রান্নার কাজে তা ব্যবহার করা যাবে না। অনেকের ধারণা, পানি ফুটালেই পানিÑআর্সেনিকমুক্ত হয়। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। তবে আর্সেনিক দূষিত পানি খাওয়া ও রান্নার কাজ ছাড়া অন্য সব কাজে ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই।
আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিণাম হচ্ছে মৃত্যু। এ দেশের গ্রামবাংলার অধিকাংশ মানুষ টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভরশীল। ১৯৯৩ সালে প্রথম জানা যায়, টিউবওয়েলের পানিতেই রয়েছে আর্সেনিক, যা পান করলে একজন সুস্থ ব্যক্তি আর্সেনিক দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে দুই এক মাস আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলেই যে কোনো ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হবে, এমন ধারণা ঠিক নয়। কতদিন আর্সেনিকদূষিত পানি পান করলে কোনো ব্যক্তি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হবেন, তা নির্ভর করে পানিতে আর্সেনিক দূষণের পরিমাণের ওপর। দেখা গেছে, আর্সেনিকদূষিত টিউবওয়েলের পানি পান করে ৫ থেকে ৮ বছর পরও মানুষের দেহে রোগের উপসর্গ দেখা যায়।
আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত রোগীর গায়ে কালো কালো দাগ দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো ত্বকও কালো হয়ে যেতে পারে। হাত ও নখের চামড়া শক্ত ও খসখসে হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত বলে প্রাথমিক লক্ষণ সমস্যার লক্ষণ চোখে কনজংটিভাইটিস দেখা দিতে পারে বা চোখ লাল হয়ে যেতে পারে বমি বমি ভাব বা পাতলা পায়খানা হওয়ার ক্ষলণ ও দেখা দিতে পারে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্তে হলে।
আর্সেনিক সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে ত্বকের বিভিন্ন স্থানে সাদা-কালো দাগ দেখা দেয়; রোগীর হাত ও পায়ের তালুর চামড়ায় শক্ত হয়ে তাতে গুটি বা গুটলি দেখা যায়; পা ফুলে যায়।
আর্সেনিক সংক্রমণের তৃতীয় বা শেষ পর্যায়ে রোগীর হাত ও পায়ে গ্র্যাংগ্রিন বা শরীরের প্রান্তঃদেশীয় অঙ্গে পচন ধরার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। ত্বক, ফুসফুস ও মূত্রথলির ক্যান্সার ও হতে পারে আর্সেনিক ও সংক্রমণ কারণে। লিভার সিরোসিস ও কিডনির কার্যক্ষমতা ও লোপ পাওয়া আর্সেনিক দূষণের ফলে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ ধরা পড়লে আর্সেনিকযুক্ত পানি খাওয়া বন্ধ করে দিলে রোগী আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়, যদিও আর্সেনিকের কার্যকর কোনো চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই আর্সেনিক সম্পর্কে সচেতন থাকলে এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, আর্সেনিক কোনো ছোঁয়াচে বা বংশগত কোনো রোগ নয়। আমাদের সচেতনতাই পারে আর্সেনিক দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
গ্রামবাংলার ৯০ শতাংশ মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক থাকার কারণে এখন তাদের ভূগর্ভস্থ পানির পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধ করে পান করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর এ বিকল্প পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি পরিশোধন করে এবং আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি ব্যবহার করার মাধ্যমে।
আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি পরিশোধনের জন্য পর্যায়ক্রমে কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হয়। আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ যদি পাওয়া না যায় তাহলে বিকল্প হিসেবে পুকুর, নদী, খাল-বিল প্রভৃতির পানি ব্যবহার করা যায়। সে ক্ষেত্রে এক কলসি (২০ লিটার পরিমাণ পানি) সংগ্রহ করার পর তাতে দশ মিলিগ্রাম বা আধা চামচ পরিমাণ ফিটকিরি মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। ফিটকিরি ব্যবহারের ফলে পানির ময়লা তলানি হিসেবে কলসির নিচে জমা হবে। উপরের পরিষ্কার পানি অন্য একটি পাত্রে ঢেলে তলানিযুক্ত পানিটুকু ফেলে দিতে হবে। এবার পরিষ্কার পানিটুকু ভালো করে ফুটিয়ে পান পানি করা যাবে। তবে কুয়ার পানি পান করতে চাইলে আর্সেনিক পরীক্ষা করে নিতে হবে। আর্সেনিক পাওয়া না গেলে কুয়ার পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।
আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি ব্যবহার করতে চাইলে বৃষ্টির পানি ও সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। কারণ, একমাত্র বৃষ্টির পানি সম্পূর্ণ আর্সেনিকমুক্ত। এছাড়া পুকুরপাড়ে বালির ফিল্টার, তিন ও চার কলস বিশিষ্ট ফিল্টার প্রভৃতির মাধ্যমে পানি পরিশোধন করা যায়। ফিল্টারের মাধ্যম হিসেবে লোহার গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। এই ফিল্টার ইউনিটটি নির্মাণ করতে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খচর হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এই ফিল্টার ইউনিট নির্মাণে দীর্ঘদিন ধরে গ্রাম পর্যায়ে সহযোগিতা করে আসছে। আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধে সংরক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অমূল সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে।
আর্সেনিক দুই দশকের পুরোনো সমস্যা। প্রাথমিকভাবে এ সমস্যাটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বর্তমানে সমস্যাটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, আট কোটিরও বেশি মানুষ আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত এবং আর্সেনিক দূষণের কারণে নারী ও শিশুসহ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী দীর্ঘস্থায়ী আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত, যা স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক কাঠামোর প্রতি সরকার মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে দারিদ্র্যের কারণে এখনও অনেক মানুষ সঠিক চিকিৎসা সেবা নিতে পারে না। যদিও সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক এ ক্ষেত্রে তৃণমূল এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর আর্সেনিক দূষণজনিত সমস্যা একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা আমাদের জীবনকে দিন দিন দুর্বিষহ করে তুলছে। আর্সেনিক সমস্যা নারী ও শিশুদের জন্য এ সমস্যা আরও বেশি মারাত্মক। তাই আর্সেনিক দূষণ সমস্যাকে অবহেলা না করে আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব গণম্যাধমসহ স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্টানগুলো আর্সেনিক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিশ্চয়ই আমরা আর্সেনিক মুক্ত সমাজ গঠনে সফল হোক।
পিআইডি নিবন্ধন