আর একটি মুখও যেন অ্যাসিডে ঝলসে না যায়

মো. সিরাজুল হক: গত ২৩ নভেম্বর বিকালে নাটোরের ডাঙ্গাপাড়া বাজারসংলগ্ন রাস্তায় বখাটে মাহিম ও তার সহযোগীরা সানজিদা আক্তারের মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। সানজিদা এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। প্রাইভেট পড়ে বাড়িতে ফিরছিল সানজিদা। অ্যাসিড নিক্ষেপের প্রতিবাদে ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকর্মীরা। এ সময় মানববন্ধনে অ্যাসিড নিক্ষেপকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি অ্যাসিড কোথা থেকে সরবরাহ হলো, তার সঠিক তদন্ত করে সরবরাহকারীকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দেয়ার দাবি জানানো হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ অ্যাসিড সরবরাহ করার সাহস না পায়। এ ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধী মাহিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা।

পারুলের বয়স এখন ৩০ বছর। এক সন্তানের মা। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় স্বামীর অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয় চার বছর আগে। কোনোভাবে জীবন বেঁচে যায়, কিন্তু ঝলসানো শরীর নিয়ে বাবার বাড়িতে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে পারুল। এ জীবন তার কাছে এখন বোঝা মনে হয়। ২০০৯ সালের পর থেকে দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের মতো সন্ত্রাস আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

বাংলাদেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা অনেকটাই কমেছে। কঠোর আইন, অ্যাসিড ক্রয়-বিক্রয়ের বাধ্যতামূলক লাইসেন্স থাকার বিধান ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণেই মূলত এ অপরাধ কমে আসতে সহায়তা করেছে, তবে ভয়ংকর এ সন্ত্রাস একেবারেই নির্মূল হয়নি এখনও। আমাদের দেশে অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো ভয়াবহ ঘটনা এখনও ঘটছে কিছু হলেও। এতে অনেকে এখনও উদ্বিগ্ন।

অ্যাসিড নিক্ষেপ একটি জঘন্যতম অপরাধ। বিশেষ করে নারীরাই অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয় বেশি। বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে দেশের অনেক নারী অ্যাসিড হামলার শিকার হয়ে চোখ-মুখসহ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে অ্যাসিড হামলায় মৃত্যুবরণও করছেন কেউ কেউ। যারা অ্যাসিড সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। পারিবারিক কলহ, যৌতুক, জমিসংক্রান্ত বিরোধ, প্রেমপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়া, স্বামীকে তালাক এবং স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে বাধা দেয়ার কারণে বরাবরই নারীরা এ ধরনের সহিংসতার শিকার হন বলে অ্যাসিড সারভাইভরস্ ফাউন্ডেশনের তথ্যে জানা যায়।

অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকার ২০০২ সালে ‘অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন’ ও ‘অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন’ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করেছে। আইনে বলা আছে, অ্যাসিড নিক্ষেপকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। দেশের প্রতিটি জেলায় অ্যাসিড নিক্ষেপ-সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আছে। জেলা ও দায়রা জজদের অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অ্যাসিড দিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তাকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে বলে অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে। অ্যাসিড দিয়ে আহত করার শাস্তি হিসেবে আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে অ্যাসিড দিয়ে এমনভাবে আহত করে, যেন দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক হারায়, মুখমণ্ডল, স্তন বা অন্য কোনো অঙ্গের বিকৃতি ঘটে বা নষ্ট হয়, তাহলে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। অপরাধীকে এক লাখ টাকা জরিমানা পর্যন্ত করা যাবে। অ্যাসিড নিক্ষেপের ফলে যদি কেউ শরীরের কোনো অঙ্গ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃতি বা নষ্ট বা কোনো স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হন, তাহলে অ্যাসিড নিক্ষেপকারীর ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। অ্যাসিড নিক্ষেপ করা বা নিক্ষেপের চেষ্টা করার শাস্তি হিসেবে যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করে বা নিক্ষেপের চেষ্টা করে এবং এর ফলে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতি নাও হয়, তথাপি অপরাধীর অনধিক সাত বছর, কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও হতে পারে। সহায়তাকারীর শাস্তি হিসেবে অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটনে কাউকে সহায়তা করে এবং এই সহায়তার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হয় অথবা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয়, তাহলে অপরাধ সংঘটনের জন্য বা চেষ্টা করার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে সহায়তাকারীও দণ্ডিত হবে।

অ্যাসিড সন্ত্রাস নির্মূলে কাজ করে যাওয়া বিভিন্ন সংগঠনগুলোর মতে, অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন ও অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ সালে প্রণীত হওয়ার পর এ-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু বিচারকাজে ধীরগতি, সাক্ষীর অভাব, মামলা পরিচালনায় অনীহাসহ নানা কারণে অ্যাসিড সন্ত্রাস পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তবে অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে। সামাজিকভাবেও মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে আগের তুলনায়।

বাংলাদেশের অ্যাসিড আক্রান্ত অনেক মানুষ সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সামাজিক নানা কাজে যুক্ত হয়ে সমাজ বদলাতে ভূমিকাও রাখছেন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েও অনেকের আত্মবিশ্বাস টলেনি। শারীরিক ক্ষত নিয়েই তারা সমাজের ক্ষত সারাচ্ছেন। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তারা ফিরছেন সমাজের মূলধারায়। অনেকে হাতের কাজ শিখে ব্লক, বাটিক, নকশিকাঁথা, দর্জি, সেলাইয়ের কাজ করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। অনেকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন।

অ্যাসিড আক্রান্তদের সমাজের বোঝা ভাবলে চলবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আইনগত, কাউন্সেলিং, চিকিৎসা দিতে হবে। তবে এটি তা একা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সরকার, সমাজ ও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে অ্যাসিড আক্রান্তদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাসিড সন্ত্রাসের মামলাগুলো দ্রুত সময়ে সঠিকভাবে বিচার করলে এ অপরাধ শূন্যের কোঠার নামিয়ে আনা সম্ভব। তবে এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী বাহিনী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভিকটিমকেও এ অপরাধের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়তে হবে। আইনের আশ্রয় নিতে হবে।

মানবসভ্যতার কলঙ্কজনক অধ্যায় হচ্ছে অ্যাসিড সন্ত্রাস। অ্যাসিড সন্ত্রাস নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চরম ঘৃণ্যতম অপরাধ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তবে ধীরে ধীরে যে অ্যাসিড সন্ত্রাস কমে যাচ্ছে এটা আশাব্যঞ্জক দিক। অ্যাডিস সন্ত্রাস একেবারে নির্মূলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা ও অত্যন্ত জরুরি।

গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। মাঠ পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠপনসমূহ ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে পারে। এছাড়া ধর্মীয় নেতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিকতা পরিবর্তনে বিশাল অবদান রাখতে পারে। সর্বোপরি পরিবারের ভূমিকা রয়েছে সবার আগে এবং সবচেয়ে বড়। আমাদের সহযোগিতা এবং সচেতনতাই পারে অ্যাসিড সন্ত্রাসমুক্ত এক সমাজ গড়ে তুলতে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০