আলুবোখারা এখন ফরিদপুরে

বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিদেশী ফল আলুবোখারার চাষ। আজকের আয়োজন ফলটির বিভিন্ন দিক নিয়ে

মসলাজাতীয় ফল আলুবোখারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি ক্যানসার প্রতিরোধক ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ। এতে খাদ্যশক্তি কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও বিশেষ উপযোগী। ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, ‘ই’ ও ‘বি’-সমৃদ্ধ একটি উচ্চমূল্যের অর্থকরী ফসল এটি। অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক। একই সঙ্গে উচ্চ পুষ্টিমান, সুগন্ধি ও ভেষজ গুণের কারণে এটি বেশ সমাদৃত। উল্লিখিত কারণে বারি আলুবোখারা-১ চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছে ফরিদপুর মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র ও হর্টিকালচার সেন্টার। এরই মধ্যে জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এ ফল চাষ করে সফলতার মুখ দেখছেন কৃষকরা।
আলুবোখারা সাধারণত ইরাক, ইরান, পাকিস্তান ও ভারতে জšে§। বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ লাভজনক হয়ে উঠেছে। ফরিদপুরের আবহাওয়া ও মাটি আলুবোখারা চাষের জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় ফরিদপুর মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র ও হর্টিকালচার সেন্টার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বারি আলুবোখারা-১ পরীক্ষামূলক চাষ করে সফলতা পেয়েছে। ফলে আলুবোখারা চাষে চাষিদের পরামর্শ ও বিনা মূল্যে চারা সরবরাহ করা হচ্ছে।
বারি আলুবোখারা-১ জাতটি উচ্চ ফলনশীল ও উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে এর ফলন দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও সম্ভব। মূলত দুই ধরনের আলুবোখারা আছেÑটেপারেট টাইপ ও ইউরোপিয়ান। ইউরোপিয়ান টাইপটির ফলন আমাদের দেশে ভালো হচ্ছে। এ গাছটি আকারে ছোট। প্রচুর ফল জšে§। এর রোগবালাই তুলনামূলকভাবে কম।
পোলাও, বিরিয়ানি, রোস্ট, সালাদ, জ্যাম, জ্যালি, আচার ও বোরহানিসহ বিভিন্ন অভিজাত খাবার তৈরিতে আলুবোখারা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমানে ফলটি আমদানি করতে হয়। কিন্তু সঠিক নিয়মে চাষ করতে পারলে আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
ফরিদপুর মসলা গবেষণা উপকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, আলুবোখারা গাছ বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত রোপণ করা যায়। অন্যান্য গাছের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে এ গাছ লাগানো যায়। কলমের গাছে দেড় থেকে দুই বছরে ফল পাওয়া যায়। মাঘের শেষ দিকে ফুল আসে। আষাঢ়ে ফল সংগ্রহ করা যায়। একটানা ৩০ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। গাছে ভালোভাবে পাকলে গাঢ় লাল বা হালকা খয়েরি জাম রং ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করা হয়।
ফরিদপুর মসলা গবেষণা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, আলুবোখারা আগে বাংলাদেশে হতো না। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, বাংলাদেশের মাটি আলুবোখারা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তিন থেকে চার বছর পর্যবেক্ষণের পর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে বারি আলুবোখারা-১ নামের জাতটি অবমুক্ত করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। আলুবোখারার যথেষ্ট বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। এর চাষ সম্প্রসারণ করতে পারলে আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে রফতানি করা যাবে। আলুবোখারার চাষ বৃদ্ধির জন্য আমরা নিয়মিত চাষিদের মাঝে বিনা মূল্যে চারা বিতরণ করছি। আশা করছি এক বছরের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ফরিদপুরে আলুবোখারার চাষ শুরু হবে।
ফরিদপুর মসলা গবেষণা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলাউদ্দিন খান বলেন, আলুবোখারা একটি সম্ভবনাময় মসলাজাতীয় ফল। আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া এটি চাষের উপযোগী। তাই ফলটি চাষে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, আলুবোখারা একটি বিদেশি মসলাজাতীয় ফল। এর নানা ধরনের ব্যবহার রয়েছে।

কে এম রুবেল, ফরিদপুর

চাষাবাদের সঠিক নিয়ম
বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিদেশি ফল আলুবোখারা। ফলটি যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, তেমনি ভেষজ গুণে ভরা। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া আলুবোখারা চাষের জন্য উপযুক্ত।
আবহাওয়া ও মাটি: আলুবোখারার জন্য সাত দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী। শীতকালের পর ফুল আসে ও ফলধারণ হয়। আলুবোখারা রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ও সুনিষ্কাশিত উর্বর বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। পাহাড়ের ঢাল বা পাহাড়ের ওপরে ভালো বায়ু চলাচল উপযোগী ও পর্যাপ্ত সূর্যালোকে এর উৎপাদন ভালো হয়।
জমি তৈরি: যে জমিতে অন্য ফসল ভালো জন্মে না, সে জমি আলুবোখারা চাষের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে। বাগান আকারে চাষ করতে হলে নির্বাচিত জমি ভালো করে চাষ ও মই দিয়ে সমতল করে আগাছামুক্ত করতে হবে। পাহাড়ি এলাকা, বাড়ির আঙিনা, রাস্তার ধার বা পুকুরপাড়ে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে জমিতে চাষ না দিয়ে শুধু পরিষ্কার করলে হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত বারি আলুবোখারা-১ জাতটি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অনুমোদন করা হয়। এ জাতটি বাংলাদেশের মাটিতে ভালো ফলন দিচ্ছে।
চাষ পদ্ধতি: সমতলে আলুবোখারা চারা সাধারণত বর্গাকার বা ষড়ভুজী প্রণালিতে লাগানো যেতে পারে। বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত অর্থাৎ মে থেকে অক্টোবর আলুবোখারার চারা রোপণ করার সঠিক সময়। চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে তিন থেকে চার মিটার দূরত্বে ৬০–৬০–৬০ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত করে রাখতে হবে। প্রতি গর্তে ১০ থেকে ১৫ কেজি কম্পোস্ট বা পচা গোবর, তিন থেকে পাঁচ কেজি ছাই, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এমওপি সার দিয়ে গর্তের ওপরের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০ থেকে ১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে চারা সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকে মাটি দিয়ে হালকাভাবে চেপে রাখতে হবে। এভাবে পুরো জমিতে চারা রোপণ করতে হয়। রোপণ করার পরপর চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে।
আলুবোখারা গাছ মাঝারি আকারের, অর্থাৎ পাঁচ থেকে ছয় মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট হয়। তবে শাখা ছাঁটাই না করলে এর গাছ ১২ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে। মাঘে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে এর ফুল আসে। আর জ্যৈষ্ঠে অর্থাৎ জুনে ফল পাকতে শুরু করে। আকর্ষণীয় উজ্জ্বল লাল রঙের ও মাঝারি আকারের দেখতে এর ফল। বেশ সুগন্ধিযুক্ত। এ ফলটি খেতে হালকা টক ও মিষ্টি স্বাদের। গাছে প্রচুর ফল ধরে। এ জাতটিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম হয়। তাই এর ফলন বেশি হয়। আলুবোখারা ৩০ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে।

উপকারী ফল
আলুবোখারা ছোট হলেও এর পুষ্টিগুণ অনেক। ডিম্বাকৃতি এ ফলটি মসলা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। শারীরিক সুস্থতার জন্য এ ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফলে ক্যানসার ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক এটি। ফলটি পেশি গঠনে সহায়তা করে।
আলুবোখারায় রয়েছে হজমযোগ্য আঁশ, আমিষ, চর্বি, শর্করা, ক্যালসিয়াম, লৌহ, পটাশিয়াম, ভিটামিন, ভিটামিন সি, খাদ্যশক্তি প্রভৃতি। আলুবোখারার বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা জেনে রাখুন।
বার্ধক্য রোধ করে: আলুবোখারা বার্ধক্যবিরোধী একটি ফল, যা বিশ্বজুড়ে বয়স্ক মানুষের কাছে সমাদৃত। তাজা বা শুকনো যেকোনোভাবেই এটি খাওয়া
হোক না কেন ফলটি তারুণ্য ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।
নার্ভের জন্য উপকারী: আলুবোখারা নার্ভের জন্য খুবই উপকারী। এটি মানসিক চাপ দূরে রাখতেও সহায়তা করে।
আকৃতি ঠিক রাখে: ১০০ গ্রাম আলুবোখারায় রয়েছে ৫০ গ্রাম ক্যালরি। ফলে শরীরের আকৃতি ঠিক রাখতে সহায়তা করে। শরীরকে ফিট রাখতে চাইলে এ ফলটি খেতে পারেন নিয়মিত।
পেটের সমস্যা দূর করে: আলুবোখারা পেটের অন্যতম বড় সমস্যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তাছাড়া পেট পরিষ্কার রাখতে আলুবোখারার জুড়ি নেই।
হার্ট সুস্থ রাখে: আলুবোখারা হার্ট সুস্থ রাখতে সহায়ক। তাছাড়া রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ক্যানসার প্রতিরোধেও আলুবোখারার ভূমিকা রয়েছে।
ত্বক বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে: আলুবোখারা সহজে ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। তাই ত্বক বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে আলুবোখারা নিয়মিত খাওয়া প্রয়োজন।
স্থূলতা কমিয়ে ফেলে: ওজন কমিয়ে তা ধরে রাখা বেশ কষ্টকর। একই সঙ্গে ধৈর্যের বিষয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ কষ্ট করে ওজন কমানোর পর আবারও আগের অবস্থা ফিরে পায়। তবে খাবারের তালিকায় আলুবোখারা যুক্ত হলে স্থূলতা শুধু কমবেই না, তা ধরে রাখতেও সহায়ক হবে।

কামরুন নাহার ঊষা

পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ
গুণগত মানসম্পন্ন ফল পেতে গাছের পরিচর্যা আবশ্যক। চারা লাগানোর পর নিয়মিত সার ও পানি দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যায় গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে চাহিদামতো ফলন পাওয়া যায়।

পরিচর্যা
# চারা রোপণের প্রথম দিকে প্রয়োজনমতো সেচ দেওয়া দরকার। খরা বা শুকনো মৌসুমে সেচ দিলে ফল ঝরা কমে, ফলন বৃদ্ধি পায়। ফলের আকার ভালো হয়
# গাছের গোড়া নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে
# চারা অবস্থায় গাছকে সুন্দর কাঠামো দেওয়ার জন্য অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে গাছের মরা, রোগাক্রান্ত ও পোকামাকড় আক্রান্ত ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে
# বারি আলুবোখারা-১ এ রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। শুধু পাতার দাগ বা লিফ স্পট রোগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে ছত্রাকনাশক স্প্রে করে তা দমন করা সম্ভব। তাই কৃষি অধিদফতরের পরামর্শ অনুযায়ী স্প্রে করুন।

ফসল সংগ্রহ
ফল ভালোভাবে পাকার পর তা সংগ্রহ করতে হয়। পেকে গাঢ় লাল বা হালকা খয়েরি রং ধারণ করলে ও ফল নরম হলেই গাছ থেকে সংগ্রহ করুন। হালকা লাল বা হলুদ অবস্থায় সংগ্রহ করা হলে তা অত্যন্ত টক বা হালকা তেতো স্বাদের হতে পারে। তাই এ অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত নয়। বারি আলুবোখারা-১-এর জাতটির প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছে দেড় থেকে তিন হাজার পর্যন্ত
ফল পাওয়া যেতে পারে। সাধারণ তাপমাত্রায় এ ফল ১৫ থেকে ২০ দিন ভালো থাকে। এছাড়া তেলে হালকা করে ভেজে চিনির সিরায় সংরক্ষণ করা যায়।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০