নাসরিন সুলতানা হিরা: একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ধূমপান। দিন দিন ধূমপায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধূমপান হচ্ছে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সঙ্গে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া। সাধারণ যে কোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নানা জাতের তামাক দিয়ে প্রস্তুত হয় সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি। তামাকের সঙ্গে সুগন্ধি রাসায়নিক দ্রব্য ও মেশানো হয়। কেউ কেউ হুক্কা, পাইপ ব্যবহার করে ধূমপান করে থাকে। যেভাবেই পান করুক ধূমপানের ফলে শরীরের ক্ষতি হবেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকসহ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যানসারসহ নানা রোগের অন্যতম প্রধান কারণ এবং ধারক ও বাহক। ধূমপানের বিষক্রিয়া প্রথমে ফুসফুস ও পরে রক্তের সঙ্গে মিশে শরীরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যায়। ফলে দেখা দেয়, যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস, দন্তক্ষয়, ক্ষুধামান্দ্য, গ্যাস্টিক, আলসার, হƒদরোগ, মাথাঘোরা এমনকি মৃত্যুর দূত ক্যানসার। চোখের দৃষ্টি এবং ঠোঁট-মুখ, দাঁত ইত্যাদির মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে ধূমপান। মস্তিষ্কে রক্তরক্ষণের মতো ভয়াবহ ব্যাধিসহ হতে পারে হƒৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালনে বাধা। জার্মান বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, বংশবৃদ্ধির ওপর রয়েছে এর মারাত্মক প্রভাব।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজমান। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের (পরোক্ষ ধূমপান) প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা যায়, এর মধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজারই হলো শিশু। শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হƒদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসারসহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় এও বেরিয়ে এসেছে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর ওপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮১ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালিত এ জাতীয় আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ৪০ শতাংশ শিশু, ৩৩ শতাংশ অধূমপায়ী পুরুষ এবং ৩৫ শতাংশ অধূমপায়ী নারী রয়েছেন। তাতে ও ফুটে ওঠে যে, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ। বিংশ শতাব্দীতে তামাক প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে উল্লেখ আছে, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫-এর ৪ ধারা অনুযায়ী প্রকাশ্যে ধূমপানের ফলে জরিমানা হিসেবে প্রথমবার অনধিক ৩০০ টাকা এবং দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রতিবারের জন্য দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। এছাড়া ১০ ধারা অনুযায়ী, সিগারেট বিড়ি ইত্যাদি তামাকজাতীয় দ্রব্যের মোড়কে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা ধূমপান হƒদরোগের কারণ’ লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমন আইন থাকার পরও আমরা দেখতে পাই, বিশ্বের যে ১০টি দেশে সবচেয়ে বেশি ধূমপায়ী বাস করে তার মধ্যে বাংলাদেশেরও নাম আছে। এছাড়া গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে পুরুষ ধূমপায়ীর সংখ্যা শতকরা হারে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর পাশাপাশি আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে তামাক ও ধূমপায়ীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন সমন্বয়’-এর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত প্রেক্ষাপটপত্রে দেখানো হয়, বাজেটে সিগারেটের ওপর যে কর ধার্য করা হয়েছে, তাতে সিগারেটের বিক্রি না কমে উল্টো ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছিলেন, এই ধারা বর্তমানেও অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তাহলে মাদকের বিস্তৃতি কমে আসবে, আর দেশের মানুষও এই বিষফোঁড়া থেকে রক্ষা পাবে।
প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকাতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলিত হয়ে থাকে। আমরা চাই, প্রতিটি দিনই তামাকমুক্ত দিবসে পরিণত হোক। যদি বহির্বিশ্বের লক্ষ্য করা করি, মেক্সিকো দেশটিতে জনসমাগমস্থলে ধূমপানের ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গোটা একটি প্রজš§কে ধূমপানমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। ভুটানে ধূমপান করলেই সেই ব্যক্তির স্থান হবে জেলখানা। তুর্কমেনিস্তানে সিগারেট কেনাবেচা নিষিদ্ধ। এছাড়া ঘানা, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, পানামা এসব দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ সরকার ধূমপানবিরোধী আইন পাস করেছে এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। ধূমপানে নিরুৎসাহিত করার জন্য সমাজের মানুষকে বোঝাতে হবে যে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ সামগ্রী’। ধূমপানের আসক্তি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি করে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে। ধূমপানকে ‘না’ বলার সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা প্রয়োজন। ধূমপানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারণা ও গণসচেতনতা চালিয়ে ধূমপান প্রতিরোধে রাখতে পারে ব্যাপক ভূমিকা। তাছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন মেনে সুস্থ জীবনযাপন করলে এবং ধূমপান ও তামাকমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখলে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষক সমাজ ও মসজিদের ইমাম-খতিবরা ধূমপান ও তামাকমুক্ত সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যেহেতু তামাক ও মাদকের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে তাই ধর্মীয় শিক্ষকরা যদি ছাত্রদের ধূমপান ও মাদকের কুফল সম্পর্কে অবহিত করেন, তাহলে অনেকেই এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবে। কাজেই শিক্ষক সমাজ যদি আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে, সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং তাদের তামাক, ধূমপান ও মাদকের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সতর্ক করে তাহলে ছাত্রসমাজের মধ্যে তামাক ও মাদক সেবনের প্রবণতা কমে যাবে। সর্বোপরি, ধূমপান বর্জনের জন্য ধূমপায়ীর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়