Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:17 am

আলোকিত মানুষ তৈরির উদ্যোক্তা

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি জীবনের নানা স্তরে তার অনিবার্য উপস্থিতি আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। বাংলাদেশের জন্য তার নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদনের ঋণ অপরিশোধ্য। সব পরিচয়কে পেছনে ফেলে তিনি আমাদের কাছের মানুষ। তিনি প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখান আমাদের। হতাশাগ্রস্তকে আশাবাদী করে তোলেন। উদ্দীপনা পেতে তার কাছে আমাদের বার বার যেতে হয়। হানাহানি, বিদ্বেষে ভরা এ পৃথিবীতে যে আনন্দ নিয়ে বাস করা যায়, তা তিনিই আমাদের জানিয়েছেন। হয়তো তাই আলোকবর্তিকা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন, শিক্ষার চেয়ে বড় কিছু নেই জগতে। তাই আলোকিত মানুষ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

১৯৬২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। সময়টুকুতে অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেন। প্রায় এক দশক ধরে ‘কণ্ঠস্বর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সময়টি ষাটের দশকের। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সূচনালগ্নে। সেখানে বিনোদনসক্ষম ব্যক্তি হিসেবে নাম কুড়ান। এর মধ্যদিয়ে তার রুচির পরিচয় পায় জাতি। টেলিভিশনে বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি কয়েকটি প্রশংসিত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন।  অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে হারজিত, সপ্তবর্ণা, আনন্দমেলা, চতুরঙ্গ, মানচিত্র, চারুপাঠ ও সোনালী দরোজা।

বহুমুখী এ ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৫ জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে। মা বেগম করিমউন্নিসা। বাবা আযীমউদ্দিন আহমদ। মাধ্যমিকে পড়ালেখা করেছেন পাবনা জিলা স্কুলে। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য চলে যান বাগেরহাটে। সেখানে প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় তিনি গড়ে তুলেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। মেধার সবটুকু ঢেলে সাজিয়েছেন সংস্থাটি। সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে মানুষকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করছেন। ৩৫ বছর ধরে এ লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ সেøাগানের মাধ্যমে সেই আশার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশের সবখানে।

একই সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনেও উদ্যোগী হয়েছেন। দেশের কল্যাণে অনেক ভূমিকা রাখছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার অর্জন করেন। মাহবুব উল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার পান ১৯৯৮ সালে। পরের বছর রোটারি সিড পুরস্কার পান। বাংলাদেশ বুক ক্লাবের পুরস্কার ঘরে তোলেন ২০০০ সালে। এম এ হক ফাউন্ডেশন কর্তৃক স্বর্ণপদক পান ২০০১ সালে। এশিয়ার নোবেল খ্যাত র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়ে পুরো জাতিকে অনন্য স্থানে নিয়ে যান ২০০৪ সালে। ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০০৬ সালে দুবার পদক অর্জন করেন। এর মধ্যে একটি ডা. ইব্রাহীম স্মৃতি স্বর্ণপদক। অপরটি শেলটেক পদক। এর তিন বছর পর ২০০৯ সালে ‘পরিবেশ’ পদক পান। পরিবেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য এ পুরস্কার অর্জন করেন। সে একই বছর মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার লাভ করেন। চ্যানেল আই আনন্দ আলো পুরস্কার পান ২০১০ সালে। ২০১১ সালে তিনটি পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে রয়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক পুরস্কার, কাজী আজাহার আলী স্মৃতি স্বর্ণপদক ও বাংলা একাডেমি পদক।

নগর জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে নিরলস সাহিত্যচর্চা করছেন। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, অনুবাদ, জার্নাল, জীবনীমূলক বই কোথায় হাত দেননি তিনি? সবখানে সমানভাবে সফল হয়েছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫৭। এর মধ্যে কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে: দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, উত্তর প্রজন্ম, বিস্রস্ত জার্নাল, খরযৌবনের বন্দী, নিউইয়র্কের আড্ডায়, মুখোমুখি, আমার বোকা শৈশব, ভালবাসার সাম্পান, সংগঠন ও বাঙালি, আমার উপস্থাপক জীবন, নদী ও চাষীর গল্প, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি, কথোপকথন, গণতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, অন্তরঙ্গ আলাপ, গল্পসল্প, গল্প সংগ্রহ, স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা, সেরা লেখা (১ম ও ২য় খণ্ড), কিশোর সমগ্র, বক্তৃতা সংগ্রহ (১ম ও ২য় খণ্ড) প্রভৃতি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ ছাড়া ৮ খণ্ডে বেরিয়েছে তার রচনাসমগ্র।

রাজর্ষী রায়, সাংবাদিক