Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 5:46 pm

চার ছাত্রীর সেই কলেজে এখন ৯৬৩ জন

আজহার উদ্দিন শিমুল: একাডেমিক ভবনে যেতেই চোখে পড়ে সারি সারি ফুলগাছ। দেখে মনে হতে পারে, কোনো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শ্রেণিকক্ষ। না, এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়। বলছিলাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার প্রথম ও একমাত্র নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুফিয়া মতিন মহিলা কলেজের কথা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মাঝখানে রয়েছে বিশাল মাঠ। চারদিকে নানা প্রজাতির গাছ আর সবুজ ঘাসে ভরা পুরো ক্যাম্পাস। দক্ষিণে বিশাল পুকুরঘাট। ক্যাম্পাসে ঢুকতেই চোখে পড়লো একদল উচ্ছল শিক্ষার্থীর আড্ডা। ‘ক্লাস নেই, তাই রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে আলোচনা করছি’জানালেন ডিগ্রি প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী।

মাধ্যমিকের পরই বিয়ে হয়ে যাওয়ার প্রবণতা আর ঝরে পড়ার লক্ষণ দেখে স্কটল্যান্ড প্রবাসী এমএ মতিন (ওবিই) ২০০০ সালে বানিয়াচংয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন সুফিয়া মতিন মহিলা কলেজ। ১৫টি  ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বানিয়াচং উপজেলায় নারী শিক্ষার আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় তিনি এ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘মেয়েদের শিক্ষায় আলোকিত করার জন্যই আমি কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছি। তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহায়তায় আমরা কলেজ প্রতিষ্ঠা করার অনুমোদন পাই।’

শুরুতে মাত্র চারজন ছাত্রী নিয়ে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। সেবার সবাই কৃতকার্য হয়েছিল। মানবিক শাখা দিয়ে শুরু হয়েছিল। বর্তমানে মানবিক শাখার পাশাপাশি ব্যবসাশিক্ষা শাখা ও বিজ্ঞান শাখাও চালু রয়েছে। ২০১২ সালে ডিগ্রি (পাস) কোর্স চালু হয়।

এবছর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতক প্রথম বর্ষের পাঠদানও চালু হয়েছে। ২৮ জন শিক্ষক ও সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে বর্তমান ছাত্রীসংখ্যা ৯৬৩ জন। ২০০৯ সালে কলেজটি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়।

এখানে ১০টি শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি রয়েছে একটি অডিটরিয়াম, একটি গ্রন্থাগার, একটি বিজ্ঞানাগার, দুটি সেমিনারকক্ষ, দুটি বিতর্ক ক্লাব ও একটি স্পিকার ক্লাব।

 

রঙিন ক্যাম্পাস, প্রাণের স্পন্দন

ক্যাম্পাসের চারদিকে রয়েছে নানা ধরনের গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বসার ব্যবস্থা। টিফিনের ফাঁকে কথা হলো এইচএসসি পরীক্ষার্থী সানজিদা স্মৃতির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কলেজটি যদি সরকারি হয়ে যায়, তাহলে আমাদের শিক্ষকদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।’

কলেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে চোখে পড়লো বিভিন্ন মনীষীর অমর বাণী। দেয়ালজুড়ে টাঙানো আছে সক্রেটিস, প্লেটো, শেলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চে গুয়েভারা, মাদার তেরেসার মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের ফ্রেমবন্দি বড় বড় ছবি। আলমারিতে শত শত বই সাজানো রয়েছে। ছাত্রীরা কেউ বই পড়ছেন, কেউবা পত্রিকা। গ্রন্থাগারিক জানান, ‘প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বই লেনদেন হয়।’ গ্রন্থাগারে কথা হয় শিক্ষার্থী সাবরিনা হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা সব সময় বই পড়তে উৎসাহ দেন।’

কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার বিতর্কচর্চা হয়। তিন মাস পরপর ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন বের করা হয়। ছয় মাস পরপর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রতি বছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও বনভোজনের আয়োজন করা হয়।

ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক পরীক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি নানা বিষয় নিয়ে ম্যাডামরা কাউন্সেলিং করেন। ফলে আমাদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।’ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক সৈয়দা জহুরা খাতুন বলেন, ‘মেয়েদের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য আমরা প্রতি ক্লাসে তিনজন করে শ্রেণি ক্যাপ্টেন নির্বাচন করি। যেন মেয়েরা এখন থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে পারে।’

 

সংকট ও সম্ভাবনা

কলেজের সাতজন ছাড়া অন্য শিক্ষকেরা নন-এমপিওভুক্ত। শুধু মানবিক বিভাগের শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রী হোস্টেল না থাকায় তাদের অনেক দূর থেকে এসে পড়াশোনা করতে হয়। কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী ও বর্তমানে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত রেজুয়ানা বীথি বলেন, ‘কলেজে একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ করা হলে অনেক ছাত্রীর কষ্ট দূর হবে।’

শিক্ষক মিলনায়তনে আলাপ হয় ব্যবসায় শিক্ষা শাখার প্রভাষক দেবু ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মাস শেষে কলেজ থেকে কী পেলাম, তা মুখ্য নয়, বরং বেলা শেষে আমার মেয়েদের প্রাণবন্ত হাসি ও ভালোবাসাই আমার কাছে সম্মানের।’

নোটিস বোর্ডে বিগত বছরের ফল দেখে জানা যায়, কলেজটি হবিগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে।

‘আলোকিত মানুষ হবে আমার মেয়েরা’

‘আমার জন্ম স্থান বানিয়াচংয়ে। নানা কারণে এ গ্রামের বেশ সুনাম হয়েছে। তবে শিক্ষার দিক হতে এ অঞ্চলের মেয়েরা পিছিয়ে ছিল। শিক্ষাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের আলোকিত করার জন্য আমাদের কলেজ নারী শিক্ষার বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানে আরও নানা বিষয়ে অনার্সসহ এমএ ক্লাস চালুর আশা রাখি। যত দ্রুত সম্ভব এখানে একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ করা হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, এ প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে আমার মেয়েরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ও ভালো মানের সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা পেশায় নিয়োজিত হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করবে। সব শেষে বলবো, এ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি মেয়েই যেন একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।’

শিক্ষার্থী