নিজস্ব প্রতিবেদক : জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমাতে জোর দিচ্ছে বিশ্ব। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌরবিদ্যুতের ওপর বাড়তি নজর দেয়া হচ্ছে। দেশেও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে বেশকিছু সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে রয়েছে আর অনেকগুলো রয়েছে অনুমোদনের অপেক্ষায়। এগুলোর মধ্যে কিছু সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে উঠেছে বেশকিছু অভিযোগ।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑসৌরবিদ্যুতে অতিরিক্ত ট্যারিফ বা উচ্চ দাম, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ, জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণসহ তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণ এবং নদীর জায়গা দখল করে রাস্তা নির্মাণ প্রবণতা।
গতকাল ‘জ্বালানি রূপান্তরে সুবিচার চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্যে এই অভিযোগ তুলে ধরে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। পাবনা, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে অবস্থিত তিনটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যবেক্ষণ শেষে এই অভিযোগগুলো উত্থাপন করে ক্যাব।
ক্যাব বলছে, পাবনার হেমায়েতপুরে ৪০০ একর জমিতে প্যারামাউন্ট গ্রুপের একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। যেখানে মোট জমির ২৫ শতাংশ সরকারি খাসজমি। আর জমি কেনার আগেই জোর করে জমি দখল নিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পাহারায় বসানো হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও ৩০ শতাংশ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাননি। এ কেন্দ্রটির ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৯০ ইউএস সেন্ট বা ১৩ টাকা ০৯ পয়সা।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ৬০০ একর জমিতে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে বেক্সিমকো লিমিটেড। সেখানে বিদ্যুতের ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১৫ সেন্ট বা ১৬ দশমিক ৬০ টাকা। আর প্রকল্পটিতে ধ্বংস করা হয়েছে তিন ফসলি জমি। ভুয়া মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে কৃষকদের। বর্গাচাষি ও দিনমজুররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। একই সঙ্গে স্থানীয়রা অঞ্চল ছাড়ায় বেড়েছে বাস্তুহারার সংখ্যা।
লালমনিরহাটে কালীগঞ্জে ১২০ একর জমির ওপর সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে ইন্ট্রোকো পাওয়ার লিমিটেডের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। কিন্তু প্রকল্পটির দখলে আছে ৩০০ একর জমি, যা কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে দখল করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিস্তা নদীর ২ কিলোমিটার ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে সড়ক। নদীর ধারে রাস্তা তৈরিতে আশপাশে এলাকায় তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। প্রকল্পটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাশে হওয়ায় বিদ্যালয়ের পরিবেশেও প্রভাব পড়েছে। এছাড়া বিদ্যুতের ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১৬ সেন্ট বা ১৭ দশমিক ৬০ টাকা। অভিযোগগুলো তুলে ধরে বেশ কিছু দাবিও তুলে ধরেছে ক্যাব।
ক্যাব বলছে, দেশে সৌরবিদ্যুৎ উন্নয়নে ৪৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র
উৎপাদনে রয়েছে। আর অনুমোদিত ২৮টি কেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি হয়েছে। এগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৫৭৯ মেগাওয়াট। আর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ৬ হাজার ৯৫৬ মেগাওয়াটের ৫৭টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘২০১৭ সালে যে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে, ২০১৯ সালে উৎপাদনে আসার কথা, এখন হয়তো এসেছে অথবা আসেনি। যত দিন যাচ্ছে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে যাচ্ছে। অথচ সেই সময়ের ট্যারিফ (মূল্য) ১৬.৬০ টাকা এখন বহাল রাখা হয়েছে। তাদের থামানো না গেলে আতঙ্কিত হচ্ছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌরবিদ্যুৎ ৭.৫০ টাকায় হচ্ছে। ইউএসএআইডি বলেছে, বাংলাদেশের রুফটপে ৫০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। যারাই গ্রিডের বিদ্যুতের নাম করে বিদ্যুৎ খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে, তারাই আবার সৌরবিদ্যুতে নেমেছে। এসব দুর্নীতি অনিয়ম রোধ করা জরুরি।’
শামসুল আলম বলেন, ‘নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দাম বিইআরসি নির্ধারণ করার কথা, সেখান থেকে আমলাদের ওপর নেয়া হয়েছে। গণশুনানির ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম ঘোষণার এখতিয়ার বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। এছাড়া ইনডেমনিটি বহাল রেখে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
সভাপতির বক্তব্যে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহের জন্য আইনটি প্রথম দুই বছরের জন্য করা হয়। এরপর দুই বছর করে মেয়াদ বাড়ানো হয়। সবশেষ পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়, এই কাজটি উচিত হয়নি। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করা উচিত। ২০০৬-০৭ সালে কী অবস্থা ছিল, সেই সময়ে কুইক রেন্টাল ও ক্যাপাসিটি চার্জ যৌক্তিক ছিল। এখন আর প্রয়োজনীয়তা নেই বলে জানান তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, জ্বালানি সংকটের মৌলিক জায়গায় নজর দিলে সমস্যাটা থাকে না। এই সংকটের মূল কারণ হচ্ছে অতি উচ্চমূলে এলএনজি, কয়লা আমদানি। এর বিকল্প যা ছিল সেদিকে নজর দেয়া হয়নি। আমাদের ভূ-কাঠামো অনুযায়ী অনেক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেউ বলছে, ৩২ টিসিএফ, কেউ বলছে ৪২ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, মৌলিক জায়গায় অতীত থেকে বর্তমান কোনো সরকারই যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। সাগরে প্রচুর গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানেও নজর দেয়া হয়নি। যদি অনুসন্ধানের হার বলি, তাহলে বছরে একটি করে কূপ খনন করা হয়েছে। প্রতিবছর ৫-৬টি কূপ খনন করা গেলে, এই সংকট থাকার কথা নয়। ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে তিনটির প্রত্যেকটিতে গ্যাস পাওয়া গেছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। প্রবৃদ্ধির জন্য বিদ্যুৎ জরুরি, তবে আমরা জনগণের কল্যাণে বিদ্যুৎ চাই। কারণ প্রবৃদ্ধি হলেই জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হয় না। আপনি যা তৈরি করলেন কিন্তু দাম মানুষের নাগালে না থাকে তাহলে তা সফল বলা যাবে না।
তিনি বলেন, ইনডেমনিটি আইন করা হয়েছে যাতে চ্যালেঞ্জ করা না যায়। এই আইনটি বাতিল করতে হবে। বিইআরসিকে পুনর্বহাল করতে হবে। বিইআরসি সচল থাকলে এলিট দুর্নীতিবাজরা আটকে যায়, যে কারণে বিইআরসিকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা যে চুক্তিগুলো করছি এগুলো কি প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক না হলে স্বচ্ছতা থাকে না। সরকারকে সৌরবিদ্যুতের মনোযোগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাত দিয়ে সম্ভব নয়। নো প্রফিট, নো লস ফর্মুলায় সৌর বিদ্যুৎ হতে হবে।