চন্দ্রশিলা ছন্দা: আজকের লেখাটি একটি কবিতা দিয়ে শুরু করতে যাচ্ছি। তার আগে বলে নিই, আমরা জানি, প্রবীণরা বটবৃক্ষতুল্য। প্রবীণরা কয়েক যুগের, কালের সাক্ষী। তাঁরা নানান অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যান। তথাপি এই ভাঙনের যুগে আবাসহীন হয়ে যাচ্ছেন প্রবীণরা; বিশেষত বৃদ্ধ নারীরা। একজন বৃদ্ধার স্বামীর যদি আগে মৃত্যু হয়, তো স্বামীর সঙ্গে তিনি ঘরও হারান। তেমনই এক হৃদয়র্স্পশী নিচের কবিতাটি।
‘বাবার বাড়ি এই গাঁয়ে, শ্বশুর বাড়ি ঐ
তোমার বাড়ি কই গো নারী, তোমার বাড়ি কই?
শিশুকাল আর কৈশোর কাটে বাবার আশ্রয়ে
যৌবন কাটে স্বামীর সাথে শ্বশুরালয়ে
বৃদ্ধকালে আশ্রয় নাই ছেলের কাছে রই
তোমার বাড়ি কই গো নারী তোমার বাড়ি কই?’
বৃদ্ধকালটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই খুব বেশি কষ্টের, বিশেষ করে আমাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশে। কিন্তু অকপটে বলতে হয় বৃদ্ধ নারীদের অবস্থা বৃদ্ধ পুরুষদের চেয়ে শতগুণ করুণ। এ কবিতাটির লেখক নারী, নাকি পুরুষ জানি না; কিন্তু আমার কাছে বড় বেদনার, বড় বেশি আত্মপ্রবঞ্চনাময় সত্য বলে মনে হয় কবিতাটি। কারণ, এখানে নারীর সারা জীবনের একটি ছোটখাটো গল্প, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সের করুণ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। সারা জীবনে নারীর নিজস্ব ঘর বলে কিছুই নেই। বৃদ্ধকালে সেই পরিণতি আরও বেশি খারাপ বর্তমান প্রেক্ষাপটে। এখন আর ছেলেমেয়ের ঘরেও বৃদ্ধদের স্থান হয় না। কিন্তু তাই বলে জীবন কি থেমে থাকে? না, থাকে না। জীবিতদের জীবন গতিময় ও গতিময় জীবনব্যবস্থা মানেই পরিবর্তনশীল। তাই সময়ের বা যুগের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারাই বুদ্ধিমানের কাজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের, একটি জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি তার নিজস্ব রূপ বদল হতে থাকে। এটাই নিয়ম। যদি এ নিয়ম না হতো, তবে আজও সবকিছু স্থবির হয়ে থাকত। শিক্ষা ও সভ্যতার অগ্রসর হতো না। বর্তমান সময়ে বৃদ্ধাশ্রমও তেমনি এক বাস্তবতা। এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে বহু মতবিরোধ আছে; বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনগণের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই সম্ভবত বৃদ্ধাশ্রমের বিপক্ষ অবস্থানে আছে বলেই ধারণা। একটি বয়সের পর বৃদ্ধ বাবা-মাকে বনবাস দেওয়ার মতো আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়াটা আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না এটা যেমন সত্য, তেমনি বৃদ্ধাশ্রম যে এখন সময়ের দাবি, এটাকেও আমি সত্য মনে করি।
সূত্রমতে জানা যায়, পরিবার থেকে বিতাড়িত ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছিল প্রাচীন চীনের শান রাজবংশ। প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আরাম-আয়েশের সব ধরনের ব্যবস্থা তখন ছিল। খাদ্য, চিকিৎসা, বিনোদন ব্যবস্থার জন্য প্রাচীন চীনের ইতিহাসবিদরা এটিকে সভ্যতার একটি অংশই মনে করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে এই বৃদ্ধনিবাস ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পায়। কারণ, সেসব দেশে মানুষের ১৮ বছর পার হলেই তারা স্বাধীন, স্বতন্ত্র। মা-বাবার কাছ থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিমতামত প্রতিষ্ঠার অধিকার তাদের দেওয়া হয়। ওদিকে মা-বাবাও তাই বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাঁধে চেপে থাকা পছন্দ করেন না। বরং তারা তাদের বয়সী বৃদ্ধদের সঙ্গেই বন্ধুর মতো করে থাকতে পছন্দ করেন। ছেলেবেলার স্কুলজীবনের মতো। এ ব্যাপারটি তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পেরেছেন। জীবনের একটি অংশ মনে করেই বদলেছেন নিজেদের এবং দেখা যায় তারা সেখানে সমমনাদের সঙ্গে গল্প-গুজবে বেশ আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন। আত্মসম্মানের সঙ্গেই থাকছেন। বাংলাদেশে ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রথম বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা প্রবর্তিত হয়। তিনিই প্রথম ‘হিতৈষী সংঘ’ ও ‘জরাবিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে সরকারি উদ্যোগে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন নির্মাণ করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বলা যায়, সারা বিশ্বে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা ও সুবিধার কথা ভেবে ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৫/১০৬ নম্বর প্রস্তাবে প্রবীণদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ‘প্রবীণ দিবস’ ঘোষিত হয়। এরপর থেকে সারা বিশ্বে বেশ মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এ ধারণা খাপ খায় না বলে বৃদ্ধাশ্রমকে কারাগার মনে করা হয়। সন্তান বড় হলে মা-বাবার দেখাশোনা সন্তানরা করবে এটাই আমাদের সামাজিক রীতি বলে বৃদ্ধ মা-বাবার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়াটাকে চরম অমানবিকতার পরিচায়ক মনে করা হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশের ৮৮ শতাংশ প্রবীণের কোনো না কোনো সন্তান দেশের বাইরে থাকেন এবং সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগও তেমন একটা নেই তাদের। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধনিবাস একটি আদর্শ স্থান হতে পারে সেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একা জীবনযাপন করেন, অথবা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকেন। আমাদের দেশে দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন। সুতরাং বার্ধক্য এদেশের জন্য অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলা করা বেশ কঠিন। ওদিকে জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসেবে শতকরা ছয় দশমিক এক শতাংশ প্রবীণ নারী-পুরুষ আছেন, যা ২০২৫ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১০.১ শতাংশে। আর এর প্রভাব বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
এখনও অনেকেই মনে করেন, যত যা-ই হোক, বৃদ্ধাশ্রম বাবা-মায়ের শেষ ঠিকানা হতে পারে না। অথচ ব্যস্ত জীবনে এমনও হয়, ফ্ল্যাট বাড়িতে বন্দি একজন বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধাকে সঙ্গ দেওয়ার কেউ নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা কিংবা রাত পর্যন্তই তাকে একা থাকতে হচ্ছে। কথা বলার কেউ নেই। তাকে এক গ্লাস পানি বা ওষুধটা এগিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেই হবে এ মানসিকতার আসলে পরিবর্তন প্রয়োজন। মানসিক প্রস্তুতি অনেক বড় এক বিষয়। আমি জোর করে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পক্ষে মত দিচ্ছি না। সংস্কার বা রীতিও ভাঙতে চাইছি না। চাইছি বাস্তবতার নিরিখে কিছু বাস্তব চিন্তাচেতনার উম্মষ ঘটাতে। আর তেমনই এক বাস্তবতার নাম বৃদ্ধাশ্রম। এ বাস্তবতায় বর্তমান সরকার দেশের ছয়টি বিভাগে ছয়টি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছে। বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন শহরে বেশ কিছু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে ইদানীং। এসব বয়স্ক কেন্দ্রে সরকারের নির্দেশে ঈদ বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হয়, যা অত্যন্ত মানবিক। এছাড়া সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু রেখেছে। এর আওতায় ১৭ লাখ দরিদ্র প্রবীণ সাহায্য পাচ্ছেন। এছাড়াও কিছু বেসরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি সংস্থা প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করছে, বিশেষ করে যারা সহায়-সম্বলহীন, তাদের জন্য। তথাপি এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হলে দেশে আরও অনেক বেশি বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে।
তবে কী করলে এই আশ্রমগুলোকে আরও সুখের আবাসরূপে গড়ে তোলা যায়, সে পরিকল্পনা থাকলে তাতে বসবাসকারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবন আনন্দময় হবে। যেমন আশ্রমগুলোর সামনে উš§ুক্ত খেলার মাঠ থাকলে কোলাহলময় একটি পরিবেশ তৈরি হয়। বিকালে বাচ্চাদের দুরন্তপনা দেখে হারিয়ে যেতে পারেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। তাদের মাঝে নাতি-নাতনির ছায়া পেতে পারেন তারা। আশ্রমের ভেতরে বা বাইরে সবজি বা ফুলের বাগান থাকলে কেউ কেউ গাছের পরিচর্যা করেও সময় কাটাতে পারেন। একটি লাইব্রেরি থাকলে যাদের বই পড়ার অভ্যাস আছে, তারা সেভাবে সময় কাটাতে পারেন। বিনোদনের জন্য টেলিভিশনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। প্রশিক্ষক দ্বারা হালকা কাজের আয়োজন করা যেতে পারে। তাদের জন্য মাঝে মাঝে পিকনিকের মতো দূরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা গেলে এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মন ফুরফুরে আর সতেজ থাকবে। সকাল-বিকাল খোলা মাঠে বা রাস্তায় হাঁটার মতো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা থাকা চাই এখানে। এছাড়াও সেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে বৃদ্ধাশ্রমগুলোয়। যারা তুলনামূলক বেশি বয়ষ্ক, তাদের কাছে সার্বক্ষণিক একজন সেবিকা থাকা খুবই প্রয়োজন। তাদের জন্য বিশেষ যত্নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ, বৃদ্ধাশ্রম একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। সরকার ও ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে ওঠা আশ্রমগুলো সমাজের মানুষের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করেই কিন্তু গড়ে তোলা হয়। আবার পরিস্থিতির কারণে আত্মীয়-স্বজনরা যাদের আশ্রমে পাঠাচ্ছেন, তাদেরও উচিত বিভিন্ন সময় বা কোনো উৎসবে তাদের হাতখরচ দেওয়া, দেখতে যাওয়া কিংবা বাসায় নিয়ে আসা। ইচ্ছে হলে কিছুদিনের জন্য সন্তান বা আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে যাওয়া-আসার মাধ্যমে পারস্পরিক একটি স্বাধীন ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থাকলে তাদের মনোকষ্ট অনেকাংশে কম হবে আশা করা যায়।
আবার তাদের যে শুধু আত্মীয়-স্বজনদেরই দেখতে যেতে হবে, এমনও নয়। ছুটির দিনগুলোয় যে কেউই বাচ্চাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে বৃদ্ধাশ্রমে বেড়াতে যেতে পারেন। এতে সেখানে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যেমন ভালো লাগবে, তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দ্য, হৃদ্যতাও বৃদ্ধি পাবে এবং তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মানবীয় গুণসম্পন্নরূপে বড় হতে সাহায্য করবে। কারণ, আজ আমরা যারা কর্মক্ষম, দাপুটে মানুষ, আগামীকাল আমাদের পরিণতিও কিন্তু এ রকমই হবে। আর এমন পরিণতিকে আশঙ্কায় পরিণত না করে সহজভাবেই নিতে হবে।
বৃদ্ধ বয়সটি যেমন সত্য, তেমনি সামাজিক এ প্রতিষ্ঠানও সত্য হোক। এ প্রতিষ্ঠানের কারণে কত দুস্থ ও অসহায়ের আশ্রয় হচ্ছে এটাও তো কম নয়। কত নিঃসঙ্গ মানুষ বন্ধুর মতো একসঙ্গে থাকার সুযোগ পাচ্ছে, সেটাকেই-বা ছোট করে দেখা কেন? এই আধুনিক সময়ে পুরোনো চিন্তায় পিছিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের কৃষ্টি-কালচারের বাইরে বৃদ্ধাশ্রম যেমন গড়ে উঠছে, তেমনি ডে কেয়ার বা মাদারস কেয়ার সেন্টারও কি গড়ে ওঠেনি? দুধের বাচ্চাদের মায়েরা সেখানে বাধ্য হয়ে রেখে কাজে যাচ্ছেন। এটাও সময়েরই দাবি। নিজের সন্তানকে লালন-পালনের সময় যাদের নেই, তারা কী করে বৃদ্ধ বাবা-মা বা আত্মীয়র দায়িত্ব বহন করবেন? এটাও তো বিবেচনার বিষয়। সুতরাং, বৃদ্ধনিবাসকে অযথা কোনো সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট আর আতঙ্কের স্থান মনে না করে বরং নির্ভরতার স্থান বা সমঝোতার স্থান মনে করা উচিত। এটা মনে করতে পারাই বদলাতে পারে আমাকে-আপনাকে। বদলাতে পারে পুরো সমাজকে। আসুন, আত্মসম্মানবোধের সঙ্গে বাঁচি। পরিশেষে বলব, নারীরা যদি নিজের পায়ের তলায় মাটি নিশ্চিত করতে না পারেন, নিজের বাড়ি বলে যদি কিছু তাদের না-ই থেকে থাকে, তো বৃদ্ধাশ্রমের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটিই ধরা যায় সসম্মানে। নিজ নিবাসের চেয়ে তা আর কম কীসে!
পিআইডি প্রবন্ধ