আফরোজা নাইচ রিমা: আশার বয়স পাঁচ মাস। হঠাৎ এক দিন পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। স্থানীয় ডাক্তার জানান, আশার চোখে আলো নেই। এজন্য সে পড়ে গেছে। অসচেতনতার কারণেই আমার মা এর আগে খেয়াল করেননি আশার পড়ে যাওয়া। বুঝতে দেরি হওয়ায় সময়মতো চিকিৎসাও করাতে পারেননি। ফলে তিনি চিন্তায় পড়ে যান কীভাবে আশাকে পড়াশোনা করাবেন এই ভেবে। খোঁজখবর নিয়ে আশার মা জানতে পারেন সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের নানা কার্যক্রমের কথা। কাটিয়ে ওঠেন হতাশা। শুরু হয় তাদের নতুন পথচলা।
অন্ধদের পড়াশোনা করার বিশেষ পদ্ধতির নাম ব্রেইল, যা লুই ব্রেইল উদ্ভাবন করেন। ব্রেইল পদ্ধতিতে ৬টি ডট দিয়ে অক্ষর, সংখ্যা, চিহ্ন ইত্যাদিকে সূচিত করা হয়। ব্রেইল পদ্ধতি প্রচলন হওয়ার পর বিশ্বের অন্ধ মানুষদের কাছে নতুন দিগন্ত উšে§াচিত হয়। তাই ব্রেইল পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য জাতিসংঘ লুই ব্রেইলের জন্মদিন ৪ জানুয়ারি দিনটিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব রাখে। ২০১৯ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।
প্রতিবন্ধিতা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা জীববৈচিত্র্যের একটি অংশ। দেশে এখন পর্যন্ত শনাক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫৪৩ জন, যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ। এর মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ২ লাখ ১৪ লাখ ৯৫৪। অনগ্রসর অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে। এ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ অংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে শিক্ষার সুযোগ পায় এবং তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচির পরিবর্তে স্থানীয় বিদ্যালয়ে চলমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এবং নিজস্ব পরিবেশ ও অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাফেরা করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশালে ৫টি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রদের পড়াশোনার সুযোগদানের জন্য এসব বিদ্যালয়ে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হয় এবং রয়েছে হোস্টেল সুবিধাও। এছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা সেবা, খেলাধুলা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করারও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এসব বিদ্যালয়ে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মানসিক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে ঢাকার মিরপুরে ৬ একর জমির ওপর ‘জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র’ স্থাপন করা হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্রের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। ‘বিশেষ শিক্ষা’ প্রদানে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ‘ব্যাচেলর ইন স্পেশাল এডুকেশন’ (বিএসএস) ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এ কলেজে এক বছর মেয়াদি বিএড সমমানের বিএসএড (ব্যাচেলর ইন স্পেশাল এডুকেশন) কোর্স পরিচালিত হয়ে আসছে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলিত কারিকুলাম অনুসরণ করে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া গণিত শেখার জন্য এবাকাস ও নিরাপদ চলাচলের জন্য ওরিয়েন্টেশন ও মবিলিটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। সূত্রমতে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি ৯৬৩ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়েছে।
সব প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে মানসিক ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের একজন অভিজ্ঞ সংগীত শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে নিয়মিত সংগীত শিক্ষা দেওয়া হয়। রয়েছে নিয়মিত শরীরচর্চা ও খেলাধুলার ব্যবস্থা। তাছাড়া স্কাউটিং বিষয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয় বয়েজ ও গার্লস গাইড প্রশিক্ষণ। স্কুলে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আর্ট, পেইন্টিং, সেলাই, কৃষিকাজ, বাঁশ ও বেত এবং কাঠের কাজ ইত্যাদি বিষয়ে প্রাক-বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা চালু আছে।
ফ্রাঙ্কোইস লেজিয়ুর (১৭৬৭-১৮২৭) গাইয়ের প্রথম অন্ধ শিক্ষার্থী, যিনি শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি তার শিক্ষকের কাজ চালিয়ে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর ২০১১ সালে স্বামীর হাতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্ধত্ববরণ করার পরও তার শিক্ষাকার্যক্রমকে ব্যাহত হতে দেননি। ব্রেইল পদ্ধতিতে তিনি পরবর্তী সময়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯৩ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়, যা জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতিমালা ১৯৯৫ প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ অনেকগুলো আইন প্রণয়ন ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শিশু নীতি-২০১১, শিশু আইন ২০১৩ এবং প্রতিবন্ধীর অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৫ অক্টোবর বিশ্ব সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৫ অক্টোবরকে বিশ্ব সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের সাদা ছড়ি দিবসের সেøাগান ছিল ‘সাদা ছড়ির উন্নতি-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অগ্রগতি’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে।
লায়নস ইন্টারন্যাশনালের হিসাবমতে, বিশ্বে ২৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষ পুরোপুরি ও আংশিকভাবে চোখে দেখে না। এসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ চলাচলের জন্য হাতে সাদা ছড়ি ব্যবহার করে থাকে, যাতে যারা চোখে দেখে, তারা যাতে তাদের চলাচলে সহযোগিতা করে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য নিরাপদে সড়কে ও অন্যান্য স্থানে চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার প্রতীক হিসেবে সাদা ছড়ির ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ২০০৭ সালে প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ সনদ (সিআরপিডি) এবং ২০০৮ সালে ঐচ্ছিক প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর অন্যতম। এ সনদটি বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী শিশুদের অবস্থার পর্যালোচনা এবং সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তির জন্য পদক্ষেপের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে ২০১৩ সালে ইউনিসেফের অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের কৌশলগত কাঠামোটি প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া সংস্থাটি প্রতিবন্ধী শিশুর বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য জাতীয় অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছে। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) সামনে রেখে ইউনিসেফ ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বেশি অনগ্রসর প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়ন, অংশগ্রহণ ও সুরক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে, ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরদের সমাজে অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে সময়মতো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রচার করছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ৪-এর ‘ক’ তে, শিশু, প্রতিবন্ধী ও জেন্ডার সংবেদনশীল শিক্ষা সুবিধার নির্মাণ ও মানোন্নয়ন এবং সবার জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর শিক্ষা পরিবেশ প্রদান করা সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি উদ্যোগের ৪ নম্বরে শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচিতে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং এ-সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৮ নম্বরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য মাসিক ভাতারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পাঠকদের কথা বিবেচনা করে ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন উপলক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণলায় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথম ধাপে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১০০ সেট (প্রতিটি ৬ খণ্ড) ব্রেইল সংস্করণ মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছে। ব্রেইল বই প্রকাশ করার ফলে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত বছরের শুরুতে বিনামূল্যে যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয় সেগুলোও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এভাবে তারা সমাজের মূলধারায় আমাদের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেল। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের এবং বিশেষ গোষ্ঠীও আমাদের গর্বিত ইতিহাসটা জানার সুযোগ পেল। আর এর মধ্য দিয়ে তারাও আমাদেরই একজন তা প্রমাণিত হলো।’ এ সঙ্গে তারাও আশা পেল, পেল নতুন জীবনের আলো।
পিআইডি নিবন্ধ