Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 8:52 pm

আশির দশকে জহুরুল ইসলাম

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-৪৩

মিজানুর রহমান শেলী: আশি আর নব্বইয়ের দশক। এ সময়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে নতুন রূপ আসে। পঁচাত্তরের পরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ অস্থির হয়ে ওঠে। শাসনপ্রণালির এক ধরনের অনিয়ম আর অস্থিরতা দেশের বাণিজ্যিক অঙ্গনকেও করে তুলেছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সত্তরের শেষের ভাগ থেকেই রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি নিয়মিত দশা বিরাজ করতে থাকে। কৃষি ও ব্যবসা উভয় খাতই তখন বেশ গুরুত্ব পেতে থাকে। এই সময়টিতে জহুরুল ইসলামের বাণিজ্যও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৮০ সালে জহুরুল ইসলামের মূলধন ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যেও জহুরুল ইসলামের ব্যবসায় তখন নানা উদ্যোগে সফলতা আসতে থাকে। বিদেশে এদেশীয় দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি হতে থাকে তার হাত ধরে। তাছাড়া দেশেও জহুরুল ইসলামের বাণিজ্যিক উদ্যোগে শীর্ষ চূড়ার রোমন্থন জমে উঠেছিল। বলা চলে আশি আর নব্বই দশকের এ সময়ই ছিল জহুরুল ইসলামের দীর্ঘ ব্যবসায় জীবনের পরিণত প্রতিচ্ছবি।
সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকেই জহুরুল ইসলাম তার ব্যবসায় সাম্রাজ্যের হারানো পথ আবার ফিরে পেতে শুরু করেন। তার কৃষি সেচ যন্ত্রপাতি প্রস্তুত কোম্পানি ও ব্যাংকিং খাতে আবার ফিরে আসেন। ১৯৮০ সালের কথা। এ সময় দেশের কৃষি অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য জিয়াউর রহমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোনো উদ্যোগেই তিনি দেশের অর্থনৈতকি খাতকে সমৃদ্ধ করতে চাচ্ছিলেন। এ সময় জহুরুল ইসলাম ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত তার সেচ যন্ত্রপাতি প্রস্তুত কোম্পানি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। ১৯৭২ সালে কেএসবি নামের এই প্রতিষ্ঠানটি জহুরুল ইসলামের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর এবার ১৯৮০ সালে তিনি নতুন করে অধিকার করার প্রচেষ্টা চালান। অবশেষে এই বছরে জহুরুল ইসলাম এই কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ার অধিকার করেন। তারপর জহুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করেন। ১৯৬১ সালের কেএসবি পাম্প কোম্পানিকে ১৯৭২ সালে কেএসবি বাংলাদেশ নামে নামকরণ করা হয়। এবার পুনরাই কোম্পানিটি দখল করে জহুরুল ইসলাম নাম দেন মিলনার্স পাম্প লিমিটেড।
১৯৮১ সালে জহুরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল সিদ্ধেশ্বরী অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প। এটাই হলো বাংলাদেশের প্রথম অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায় প্রকল্প। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের অ্যাপার্টমেন্ট শিল্প ধারণার অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
১৯৮২ সালে জহুরুল ইসলাম আফতাব অটোমোবাইল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে সহায়তা করেছিল জাপানিরা। এর উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের বাজারে টয়োটা ও হিনো ভেহিকলের মাঝে সমন্বয় করা। অর্থাৎ এই সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে গড়ে উঠল প্রাইভেট খাতে সবচেয়ে বড় অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলিং প্লান্ট। এদিকে চট্টগ্রামেও চলত গাড়ি অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজ। এটা বিভিন্ন ধরনের গাড়ির কাঠামো নির্মাণ করে। বিশেষ করে জিপ ও ট্রিক-আপের কাঠামো নির্মাণ করে। ১৯৮২ সালে আফতাব অটোমোবাইল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে সারা দেশে এসব গাড়ির কাঠামো ছড়িয়ে পড়ে। দেশের রাস্তায় রাস্তায় এগুলোই সাধারণত চোখে পড়ত।
জহুরুল ইসলাম তার নিয়মিত ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি হারানো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান উদ্ধারে এ সময়েও বেশ সচেষ্ট ছিলেন। এবার ১৯৮৩ সালের কথা। ১৯৬৫ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিডিউলড ব্যাংক হিসেবে ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর আওতায় এই ব্যাংকটিকেও জাতীয়করণ করা হয়। এরপর ১৯৮৩ সালে ব্যাংকটিকে জহুরুল ইসলাম আবার প্রাইভেটাইজেশনে নিয়ে আসে। নতুন নাম দেওয়া হয় উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড। এটাই বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে তখন থেকে যাত্রা শুরু করে।
এরপর ১৯৮৮ সালে জহুরুল ইসলাম হিনো কমার্শিয়াল ভেহিকল সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠান করেন। বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন হিনো পণ্য সরবরাহ করা ছিল হিনো কমার্শিয়াল ভেহিকল সার্ভিস সেন্টারের কার্যাবলি। কার্যত যে কোনো প্রতিষ্ঠান পণ্য বিক্রির পরে তার দায় শেষ করে ফেলে। এটাকে পণ্যবাণিজ্যের টেকসই কাঠামো বলা চলে না। বরং একটি টেকসই কাঠামো হলো, সেই পণ্য ব্যবহার করতে ভোক্তাকে পরিষেবা নিশ্চিত করা। কেননা, ভোক্তা একটি পণ্য ক্রয়ের পরে তার স্থায়িত্ব ও সুবিধার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চান। এই দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে হিনো কমার্শিয়াল ভেহিকল সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠান যানবাহন বিক্রির পরে তার পরিষেবা নিশ্চিত করত। এখানে সব ধরনের উপকরণের মেরামত কাজও করা হতো। জ্বালানিবিষয়ক বিভিন্ন পরিষেবাও এখানে দেওয়া হতো। বাসের এয়ারকন্ডিশন এখানে স্থাপন ও মেরামত করা হতো। এই প্রতিষ্ঠানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও ছিল। এই কেন্দ্রে বিক্রীত গাড়ির চালক ও কারিগরদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। এখানে থেকে পণ্যের মাঠ পর্যায়ের পারফরম্যান্স পরীক্ষা করা হতো। তাছাড়া রাস্তায় নেমে কোথাও কোনো দুর্ঘটনায় বা জরুরি পরিস্থিতিতে সেবা পাওয়ার জন্য এ পরিষেবা কেন্দ্রের দুটি জরুরি বিভাগ রাখা হয়েছিল। এ জরুরি বিভাগে যাবতীয় উপকরণাদি মজুত থাকত। এভাবেই যানবাহনের বাজার দখলে জহুরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান কেবল ব্যবসায় সফলতাই অর্জন করেননি। বরং এর সঙ্গে কুড়িয়েছেন ব্যবসায় পেশাদারিত্ব, সততা আর দায়িত্বশীলতার সুনাম। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জহুরুল ইসলামের গাড়ি বিক্রি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজার দখল করে সমহিমায় টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে।
গাড়ির পাশাপাশি নির্মাণকাজে জহুরুল ইসলামের ব্যবসা আশির দশকে থেমে থাকেনি। চলেছে সমান্তরাল গতিতে। কার্যত, আগের দশকগুলোর মতোই আশির দশকে বিডিসি তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ করে। যেমনÑ১. দিলখুশার জীবন বিমা করপোরেশনের হেড কোয়ার্টার, ২. রমনার আরএইচডির হেডকোয়ার্টার, ৩. বগুড়ার বাংলাদেশ ব্যাংক বিল্ডিং, ৪. ডিডব্লিউএএসএ’র হেডকোয়ার্টার-কারওয়ান বাজার, ৪. কুমিল্লা চান্দিনা ১৩ কিলোমিটার বাইপাস রোড, ৫. চট্টগাম বন্দরে ফ্লাইওভার, ৬. খুলনায় বাইপাস রোড, ৭. এলজিইডি ভবন ও ৮. বুয়েটের নিউ একাডেমিক ভবন।
এই বিডিসি বা বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড ও ইসলাম গ্রুপে পাঁচ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেন। এই প্রধান দুই প্রতিষ্ঠানের বাইরে তার ছিল আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলোÑ১. মিলনার্স লিমিটেড, ২. ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, ৩. নাভানা লিমিটেড, ৪. এসেনসিয়াল প্রডাক্টস লিমিটেড, ৫. ঢাকা ফাইবারস লিমিটেড, ৬. নাভানা স্পোর্টস, ৭. নাভানা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ৮. মিলনার্স পাম্প লিমিটেড, ৯. ইসলাম ব্রাদার্স প্রপার্টিজ লিমিটেড, ১০. ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ইত্যাদি।
এ প্রতিষ্ঠানগুলো জহুরুল ইসলামের স্বপ্নকে জীবন্ত করে তুলেছে। অল্প অর্জনের ভেতর দিয়ে তিনি তার পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুঁজির পর্যাপ্ততা তাকে নিয়ত নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সে সময়ে তার এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছিল।

গবেষক, শেয়ার বিজ