মো. আবদুর রহমান: গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। দেশের জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নতির ওপরই নির্ভর করে। তাই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক।
দেশের সীমিত জমির ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙন, বিকল্প কর্ম সৃষ্টির অভাব এসব কারণে বাংলাদেশে ভূমিহীন ও নদীভাঙন কবলিত পরিবারের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। তারা শহরে এসে বস্তিতে কিংবা ফুটপাতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর ভাসমান জীবনযাপন করে। এসব অসহায় দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে সরকারি খাসজমিতে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নকল্পে ‘আশ্রয়ণ’ নামক একটি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। ‘আশ্রয়ণ’ মূলত মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক একটি সমন্বিত গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি।
১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হওয়ায় বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। সেসময় তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই এলাকা পরিদর্শনে যান। তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন এবং এসব গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে সারাদেশে সরকারি খাসজমিতে ব্যারাক হাউস নির্মাণের মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করার কার্যক্রম চলছে। প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চার লাখ ৪২ হাজার ৬০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় তালিকাভুক্ত সব পরিবার পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসিত হবে।
আশ্রয়ণ মানে কেবল আবাসনের ব্যবস্থা নয়; বরং এটির পরিধি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। উপকারভোগীরা বিনা মূল্যে দুই শতাংশ করে জমি ও একটি অর্ধ পাকা দুই কক্ষের টিনশেড ঘর পেয়েছেন। এতে রয়েছে গোসলখানা, টয়লেট, রান্নাঘর ও বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ। গৃহসহ জমি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে যৌথভাবে দলিল করে দেয়া হয়েছে।
প্রকল্প এলাকায় বাসগৃহের আশেপাশের জমিতে পরিকল্পিতভাবে শাকসবজি ও ফলমূলের বাগান স্থাপনের মাধ্যমে পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর প্রয়োজনীয় পুষ্টিচাহিদা পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল বাজারে বিক্রি করে বাড়তি কিছু অর্থও উপার্জিত হবে। আবার প্রকল্প এলাকায় সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণ করা হবে। এসব গাছপালা একদিকে যেমন আশ্রয়ণে পুনর্বাসিত পরিবারগুলোকে ছায়া, ফলমূল, জ্বালানি কাঠ প্রভৃতির জোগান দেবে; অপরদিকে এসব গাছপালা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সুস্থ ও নির্মল রাখতে সহায়ক হবে। তাছাড়া আশ্রয়ণ কেন্দ্রে প্রতি ১০টি পরিবারের সুপেয় পানির জন্য থাকছে একটি করে নলকূপ। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন সুবিধাভোগীরা। তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আশ্রয়ণের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের শরীর গঠন ও বিনোদনের জন্য প্রকল্প এলাকায় রয়েছে খেলার মাঠ। বস্তুত আশ্রয়ণ প্রকল্পে আধুনিক গ্রামের সব নাগরিক সুবিধাই থাকছে প্রকল্প এলাকায়। এছাড়া উপকারভোগীদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে আয়বর্ধনকারী ব্যবসা বা পেশা চালুর জন্য তাদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। অধিকন্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসিত পরিবার মাতৃত্বকালীন, বয়স্ক, বিধবা বা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিবারগুলোর খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য প্রকল্প এলাকার আশেপাশের জমিতে শাকসবজি ও ফলমূল চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, ক্ষুদ্র জলাশয়ে মাছ চাষ এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন কার্যক্রম সফল করতে পুনর্বাসিত পরিবারের নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কেননা প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের গ্রামীণ নারীরা প্রায় প্রত্যেক বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাদের খাদ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও সেবা-যত্ন নারীরাই করে থাকেন। তাদের মাংস ও ডিম অসুবিধা ভোগীদের প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহ করে। গবাদিপশুর (গরু, ছাগল, ভেড়া) খাদ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও তাদের পরিচর্যার মাধ্যমে গবাদিপশু পালন ও দুধ উৎপাদনেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের প্রোটিনের অভাব দূরীকরণে নারীরা তাদের বাসগৃহে আধুনিক পদ্ধতিতে উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামার গড়ে তুলতে পারেন। এছাড়া পুনর্বাসিত পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় খননকৃত ডোবা ও গর্তজাতীয় ক্ষুদ্র জলাশয়ে মাছ চাষ করতে পারেন। এর ফলে একদিকে যেমন তাদের প্রোটিনজাতীয় খাদ্যের ঘাটতি অনেকটা পূরণ হবে, অপরদিকে বাড়তি অংশ বিক্রি করে পুনর্বাসিত পরিবারের কিছু বাড়তি আয়েরও সংস্থান হবে।
শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ভিটামিন ও খনিজ লবণের উৎকৃষ্ট উৎস শাকসবজি ও ফলমূল। শাকসবজি ও ফলমূলে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এতে ভিটামিন ও খনিজ লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান দুটির চাহিদার প্রায় সবটুকুই উৎপাদিত এসব শাকসবজি ও ফলমূল থেকে পূরণ হয়ে থাকে। শরীরকে সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত রাখার জন্য দৈনিক কোনো শিশুর জন্য কমপক্ষে ১০০ গ্রাম ও পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ২০০ গ্রাম শাকসবজি এবং ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৩০ গ্রাম শাকসবজি ও ৭০ গ্রাম ফল খেয়ে থাকে। সুতরাং আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্য তথা দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর শাকসবজি ও ফলের চাহিদা পূরণের জন্য প্রকল্প এলাকায় বাসগৃহের আশেপাশের জমিতে বেশি করে শাকসবজি ও ফলের চাষ করা একান্ত প্রয়োজন। এসব জমিতে পরিকল্পিতভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ শাকসবজি ও ফলের বাগান করে সব সময় টাটকা শাকসবজি ও ফল খাওয়া যায়। উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল পুনর্বাসিত পরিবারের পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত অংশ বাজারে বিক্রি করে বাড়তি কিছু অর্থও উপার্জন করা সম্ভব।
আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার জমিতে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় অবদান রাখতে পারেন। গৃহস্থালির কাজে অভ্যস্ত একজন নারী অতি সহজেই শাকসবজি ও ফল চাষের সঙ্গে জড়িত জমি প্রস্তুতকরণ, শাকসবজি ও ফলমূলের বীজ/চারা রোপণ, সার প্রয়োগ, আগাছা বাছাই, পানি দেয়া, পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন, ফসল তোলা, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মতো কাজগুলোয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাছাড়া বাসগৃহের আশেপাশের বাগান থেকে উপযুক্ত পরিমাণে শাকসবজি উত্তোলন ও সঠিক রন্ধনপদ্ধতি অবলম্বন করে শাকসবজির পুষ্টিমান বজায় রাখার কাজও তারা অতি সহজেই করতে পারেন। এ বাগানে সবজি ও ফল চাষের আরেকটি সুন্দর দিকও রয়েছে। এ ধরনের বাগানে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরাও অংশ নিতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই বাগান করার অভ্যাস গড়ে ওঠার পাশপাশি নিয়মিত শাকসবজি আর ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে। বস্তুত আশ্রয়ণের জমিতে শাকসবজি ও ফল চাষের প্রতি পুনর্বাসিত নারীরা আগ্রহী ও যতœবান হলে সবদিক থেকে লাভবান হওয়া যায়।
সর্বোপরি আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে শাকসবজি, ফলমূল ও মাছ চাষ এবং গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি প্রতিপালনের জন্য পুনর্বাসিত নারীদের উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান, প্রকল্প এলাকায় উৎপাদিত পণ্য সুষ্ঠু বিপণনে সহযোগিতা, উপকরণ সরবরাহ ও তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সরকার গৃহীত প্রশংসনীয় এ উদ্যোগ আরও সফল ও আরও ফলপ্রসূ হবে, যা উপকার করবে প্রকল্প এলাকার সুবিধাভোগীসহ আমাদের সবার ক্ষেত্রে, তথা দেশের জন্যও বটে।
পিআইডি নিবন্ধ