বনশ্রী ডলি: সরকারের দেয়া পাকা ঘর পেয়ে কান্না সামলাতে পারেননি সাঁওতাল পল্লির ৮০ বছর বয়সী মধু হাসদা। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের সনকা সাঁওতাল পল্লির বন-জঙ্গলের ঝুপড়ি ঘরে কাটিয়ে দিয়েছেন এতগুলো বছর। জীবনের শেষ বেলায় এসে সরকার থেকে ঘর পাচ্ছেন, নির্মাণাধীন ঘর দেখতে এসে ঘরের দেয়ালের ইটগুলো ছুঁয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মধু।
ঝুপড়ি ঘরেই থাকাটা নিয়তি মেনেছিল দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের শাহনাজ পারভীন-হামিদুল ইসলামের পরিবার। তাদের পাকা ঘর হবে ভাবতেই পারেননি। সরকার থেকে ঘর পাচ্ছেন, নিজের ঘর দেখতে এসে ঘরের দেয়াল জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। আনন্দাশ্রু মুছতে মুছতে শাহনাজ বলতে থাকেন, আমাদের কিছুই ছিল না, মানুষের জায়গায় খড়ের ঘর তুলে থাকি। ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে রাতদিন পার করেছি। এবার সেই দুঃখ দূর হতে চলেছে। শেখ সাহেব আমাদের দেশ স্বাধীন করে দিয়েছে। এবার তার বেটি শেখ হাসিনা আমাদের পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। তার প্রতি আমরা অনেক খুশি।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল কাদের জানান, এ উপজেলার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা ২ হাজার ৪৭টি, প্রথম পর্যায়ে ৩৫০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে; পর্যায়ক্রমে সব গৃহহীনকে মুজিববর্ষের মধ্যেই পুনর্বাসিত করা হবে। এই প্রকল্পে প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়েছেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁতওাল সম্প্রদায়ের লোকজনও। নিজের ঘর পেয়ে সাঁওতাল নারী-পুরুষ আবেগাপ্লুত হয়ে তাদের অনুভূতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, ঝড়-তুফান হলে ঘর উড়ে যায়, কষ্ট করে ঠিক করলেও আবার উড়িয়ে নিয়ে যায়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিছে, ঘর পেয়ে আমরা অনেক খুশি, সন্তুষ্ট। সন্তান-সন্ততি নিয়ে ভালো থাকার জন্য নিজেদের নতুন ঘর পেয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তাদের সুখী চেহারা ও স্বস্তির উচ্চারণ সত্যিই ভালো লাগার। তাদের দেখে সারাদেশের গৃহহীনরা আশা করছেন তাদেরও একদিন ঘর-বাড়ি হবে।
‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না’Ñপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে সারাদেশে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সারাদেশে বাস করা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাড়ে তিন হাজার পরিবার ঘর উপহার পাবে সরকারের পক্ষ থেকে। গোবিন্দগঞ্জের সমতল ভূমির ৫০টি পরিবার পেয়েছে তিনটি করে পাকা ঘর। গেল বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঘর হস্তান্তরের দিন উপস্থিত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মো. তোফাজ্জল মিয়া বললেন, বিশেষ এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি আছে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে এই কর্মসূচির আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে সমতলে বাস করা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তিন হাজার পাঁচশটি গৃহহীন পরিবার ঘর পাচ্ছে।
গোবিন্দগঞ্জের মতো রংপুরের সৈয়দপুরেও ৪০টি গৃহহীন পরিবার সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছে আধাপাকা দুটি ঘরসহ একটি করে ছোট্ট বাড়ি। সেই সঙ্গে প্রায় দুই শতাংশ জমির মালিকানার দলিলও হস্তান্তর করা হয়েছে। ঠিকানাবিহীন মানুষগুলো নিজেদের বাড়ি পেয়ে বেঁচে থাকার অর্থ যেন নতুন করে পেয়েছে। সরকারের এই উপহার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে মনে করছেন তারা। নিজের বাড়ির দলিল হাতে পেয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আনন্দাশ্রু সামলে এক মধ্যবয়সী বললেন, এতদিন মানুষের বাড়িতে থাকতে হয়েছে, এখন নিজের জমি বাড়ি হয়েছে, এটা অনেক বড় পাওয়া।’
বর্তমান সরকারের এই শুভ উদ্যোগের সুফল থেকে বাদ পড়েননি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হিজড়ারাও। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলো ভোটাধিকার পেয়েছে কিন্তু সমাজের মূল স্রোতে স্বাভাবিক কাজকর্ম করে বসবাস করার অধিকার যেন তাদের নেই। ওদের অঙ্গভঙ্গি ও আচরণভিন্ন রকম হওয়ায় বাসা-বাড়িতে বা অফিসে এরা কাজ পায় না, বাড়িওয়ালারা এদের কাছে বাসা ভাড়া দিতেও চান না। এই জনগোষ্ঠীর কয়েকজন ছাড়া বাকিদের জীবন মানবেতর বলা যায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তৃতীয় লিঙ্গের ২০ জন ঘর পেয়েছেন। বাড়িঘর পেয়ে তারা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন। বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি, গরু ও ছাগল লালন-পালন করাসহ নানা ধরনের কাজ করে স্বাবলম্বী তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য মায়া, রূপা ও আলো সমাজের অন্য দশটা মানুষের মতো বাঁচার পথ পেয়েছেন। নতুন জীবনের ঠিকানা পেয়ে খুশি ও কৃতজ্ঞ তাদের এক সদস্য জানালেন, আগের পেশা থেকে সরে এসে উল্লাপাড়ার এই ২০ জন যেভাবে স্বাবলম্বী হয়েছি, আমরা ভালো আছি, তবে এই উপজেলায় বসবাসকারী বাকি ৫৮০ জনসহ আমাদের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা অন্য সদস্যরাও সরকারের সহায়তায় স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটাই আমাদের দাবি।
প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে ঘর নির্মাণ ও হস্তান্তরের সংবাদ ও প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার হচ্ছে নিয়মিতই। তেমনই কয়েকটি : (খবর) প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বাড়ি পেয়ে খুশি চিরিরবন্দরের ১২৫ পরিবার, (উইমেন নিজউ-২৪ ডিসেম্বর, ২০২০), মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার পাকা বাড়ি পাচ্ছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের ১২৫ পরিবার। আগামী ৩০ ডিসেম্বর এসব বাড়ি তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এই উপহার পেয়ে খুশি ভূমিহীন পরিবারগুলো।’
‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’এ প্রতিপাদ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে ‘ক’ শ্রেণির পরিবারের পুনর্বাসের লক্ষ্যে ৩৫০টি সেমিপাকা ঘর নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উপহার ‘স্বপ্ন নীড়’। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১০০ ঘর হওয়ায় উপজেলার গৃহহীন পরিবারগুলোর মুখে হাসি ফুটেছে। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে হস্তান্তর করা। বীরগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) জানান, এ উপজেলার ১৬টি স্থানে মোট ১১.৫০ একর সরকারি খাসজমিতে নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে চলছে। প্রতি ঘরে দুটি কক্ষ, একটি বাথরুম, একটি রান্নাঘর, বারান্দাসহ প্রতি উপকারভোগী গড়ে দুই থেকে তিন শতাংশ জমি বন্দোবস্তসহ উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। উপকারভোগীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’ (২৯ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ২০২০-এ ‘উইমেন নিজট ২৪’ অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত) এমন সংবাদগুলো পড়ে রাজধানীর এক ফ্ল্যাটের মালিক সিতারা আলম ও তার ১৯ বছরের কন্যা শাহীনা খুশি হয়ে বললেন, এমন গৃহহীন ও আশ্রয়হীনদের ঘর দেয়ার ব্যবস্থা করায় প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ। এমন শুভ উদ্যোগে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে সরকারের দেয়া তথ্য বলছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনানুষ্ঠানিক শুরুটা হয় ১৯৯৭ সালে। ওই বছর ১৯ মে কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলবাসী বহু পরিবার গৃহহীন ও আশ্রয়হীণ হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের মাধ্যমে পুনর্বাসিত পরিবারগুলোকে প্রশিক্ষিত করে তাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা হয়। এটি একটি সমন্বিত দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প। আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০০২-২০১০ মেয়াদে আশ্রয়ণ ফেইজ-২-এ আশ্রয়ণ ২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এ পর্যন্ত প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। প্রথম দিকটায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে কেবল ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষদের সরকারের খাসজমিতে ব্যারাক হাউসে পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু যেসব মানুষের খুব সামান্য, সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমি রয়েছে, কিন্তু ঘর নেই বা ঘর তৈরি করার সামর্থ্য নেই, তাদের এ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসনের কোনো সুযোগ ছিল না। পরিস্থিতি বিবেচনায় ফেইজ ২ (দুই) তে সংশোধিত ডিপিপিতে পাইলট আকারে প্রতি ইউনিয়নে ১ (একটি) করে এমন পরিবারকে নিজ জমিতে ঘর করে দেয়ার বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়। প্রথম ভাগে চার হাজার পরিবারকে ঘর করে দেয়া হয়েছে, এর সুফল মিলেছে এবং পেয়েছে জনপ্রিয়তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার জন্য বাসস্থান নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথম দিকে সারাদেশে বা পাইলট আকারে চার হাজার পরিবার পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত থাকলেও বর্তমানে পরিবারে সংখ্যা বেড়ে এক লাখ ৭০ হাজারে উন্নীত হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এক লাখ ৭০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসনে আগের নীতিমালাটি সংশোধনও করা হয়েছে। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ নীতিমালায় ৯টি ক্রমভাগ রয়েছে। যেমন প্রকল্পের সম্পদ দ্বারা কোনো মাটির কাজ করা হবে না। প্রয়োজনীয় টিন কাঠ, প্রি কাস্ট পিলার, দরজা-জানালা ইত্যাদি সংগ্রহ করা যাবে। কোনো ধরনের ঘর করা হবে এবং কীভাবে কাজ হবে, কে কোনো দায়িত্ব পালন করবেন, বিষয়ে রয়েছে বিশদ বিবরণ। সে অনুযায়ী গৃহহীনদের তালিকা করে ঘর ও বাড়ি বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার নিশ্চিত ব্যবস্থা করে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তা তিনি করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে গৃহহীনদের ঘর দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। একদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছর অন্যদিকে জাতির পিতার জন্মশত বছর। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই মানুষ আশ্রয়হীন ও দরিদ্র হয়ে পড়ে। একদিকে বাংলাদেশ এগিয়েছে, উন্নয়নের পথে অন্যদিকে ভূমিহীন ও গৃহহীনের সংখ্যাও বাড়ছে। এ সংকট সমাধানে সরকারের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প চলমান। মুজিববর্ষ পালনে শত উদ্যোগ আর আয়োজনের সবচেয়ে বড় আয়োজন এদেশের গৃহহীনদের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা করা। ‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না’প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হচ্ছে জোরেশোরে। তবে কেবল মুজিববর্ষেই নয়, এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকুক, এমনটাই বলছেন বিশিষ্টজনরা। আশ্রয়ণ প্রকল্প চলমান থাকুক গৃহহীনদের আশার আলো আর ভরসাস্থল হয়ে।
পিআইডি নিবন্ধ