রহমত রহমান: বিশ্বে ই-সিমের ব্যবহার বাড়ছে। ই-সিম মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের যোগাযোগের সহজ মাধ্যম। আধুনিক বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্যিক চাহিদাÑএককথায় আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশকে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ই-সিমের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ই-সিম তদারকি করতে পারলে একদিকে রাজস্ব বাড়বে, অন্যদিকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে।
বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরগুলো ই-সিম চালুর বিষয়ে এখনও সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। তবে ই-সিম চালুর ক্ষেত্রে অপারেটরগুলো আইনি জটিলতায় পড়তে পারে। কারণ মূসক আইনে সিম কার্ডের মূসক নির্ধারণ করা এবং সিম কার্ড বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া আছে। কিন্তু ই-সিম বা ভার্চুয়াল সিমের কর নির্ধারণের বিষয়ে নির্দেশনা নেই। দেশে ই-সিম চালুর আগে আইন ও বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), মূল্য সংযোজন কর-দপ্তরে ই-সিম বিষয়ে পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের প্রতিনিধি, বিটিআরসি প্রতিনিধি ও এলটিইউ কর্মকর্তারা আইন ও বিধি সংশোধনের সুপারিশ করেন। সভায় এলটিইউয়ের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন।
এনবিআর সূত্রমতে, এলটিইউ মোবাইল খাত থেকে বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছর আট হাজার ৪৬৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় করেছে। এলটিইউ’র মোট আদায় করা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের ১২ শতাংশ আদায় হয় মোবাইল খাত থেকে। বর্তমানে প্রতিটি সিম থেকে ২০০ টাকা হারে মূসক আদায় করা হয়।
সভায় এলটিইউয়ের কমিশনার বলেন, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো দেশের অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত এবং এই দপ্তরের রাজস্ব আহরণে এ খাতের অসামান্য অবদান রয়েছে। বর্তমানে সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল ফোন। যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোনে সিম কার্ড ব্যবহার করা হয়, যা মোবাইল ফোনকে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করে। মোবাইল ফোন উৎপাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে মোবাইল ফোনে এম্বেডেড সিমযুক্ত ডিভাইস চালু করছে, যা ই-সিম হিসেবে পরিচিত।
মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রতিনিধিরা ই-সিমের ‘টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের’ ওপর একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন, যাতে বলা হয়, ই-সিম বিষয়টি বর্তমানে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ পর্যায়ে রয়েছে। ই-সিম হচ্ছে ‘ইলেকট্রনিক সিম কার্ড’, যা বর্তমানে প্রচলিত প্লাস্টিক সিম কার্ডের পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে। সাধারণত ই-সিম হচ্ছে এক ধরনের মাইক্রোচিপ, যা মোবাইলের মাদারবোর্ডে যুক্ত থেকে ক্যারিয়ার নেটওয়ার্ককে সংযুক্ত করে। ই-সিমের ব্যবহার বাংলাদেশে এখনও শুরু হয়নি। তবে ই-সিম চালুর বিষয়ে সব সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
আরও বলা হয়, বিশ্বে গুগুল’স পিক্সেল ২ মোবাইল ফোন সর্বপ্রথম এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে এবং অ্যাপল ওয়াচ ৩-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। ই-সিমের প্রধান সুবিধা হচ্ছে এটি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মোবাইলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং একইসঙ্গে অনেক ক্যারিয়ার ও প্রোফাইল ব্যবহার করা যায়। ই-সিম সংযোগ গ্রহণের জন্য ক্লাউড থেকে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রোফাইল ডাউনলোড করে ই-কেওয়াইসি বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে গ্রাহকের তথ্য যাচাই করে ই-সিম ক্রয় ও রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
প্রতিনিধিরা বলেন, এক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থিত বিদেশি কোম্পানি থেকে এই সেটের মাধ্যমে অ্যাপ ক্লাউড থেকে ডাউনলোড করে ভার্চুয়াল সিম কিনতে হবে। এই আমদানি করা সেবার বিপরীতে মোবাইল অপারেটররা প্রযোজ্য মূসক ও শুল্ককর জমা নিশ্চিত করবে। ই-সিমে একাধিক প্রোফাইল ডাউনলোডের সুযোগ থাকলেও একইসঙ্গে একাধিক প্রোফাইল ব্যবহার করা যাবে না। মোবাইল ফোনে যদি একাধিক অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক সংযুক্ত থাকে, তাহলে একইসঙ্গে একাধিক নেটওয়ার্ক সংযোগ চালু রাখা যাবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের এবং আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য ই-সিম চালু করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সূত্রমতে, সভায় ভ্যাট অফিসের কাছে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির প্রতিনিধিরা ই-সিম সংযোগ বা পুনঃসংযোগের ক্ষেত্রে মূসক হার কত হবে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। কেননা ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২’-এর তৃতীয় তফসিলের টেবিল-৪ ‘খণ্ড-খ’-এ সিম কার্ড সরবরাহের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মূসক ২০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ই-সিম অর্থাৎ ‘ভার্চুয়াল সিমের কর নির্ধারণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই’।
বিটিআরসির প্রতিনিধি বলেন, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো ই-সিম বিষয়ে বিটিআরসিকে এখনও কোনো চিঠি দেয়নি। যদি ই-সিএম বাংলাদেশে চালু করা হয়, সেক্ষেত্রে বিটিআরসি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ই-সিমের অপারেশনের বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
মূসক আইন অনুযায়ী, বর্তমানে সিম কার্ড সরবরাহকারী সেবার বিপরীতে প্রতি সিমে ২০০ টাকা হারে মূসক নির্ধারণ করা আছে। আবার এনবিআরের ২০১৯ সালের এক আদেশে (এসআরও-১৮৬/২০১৯) সিম কার্ড সরবরাহকারীর ব্যাখ্যা দেয়া আছে, যাতে ই-সিম সরবরাহকারীর ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ই-সিম থেকে রাজস্ব আদায় করতে হলে মূসক আইন ও বিধি সংশোধন করতে হবে বলে সভায় উপস্থিত সবাই মত দেন।
সভায় দুটি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে প্রথম হলোÑমূসক আইনের তৃতীয় তফসিলে সিম কার্ড সরবরাহের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মূসক হার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে, কিন্তু ই-সিম বা ভার্চুয়াল সিমের কর নির্ধারণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। সেজন্য ই-সিম সংযোগ বা পুনঃসংযোগের ক্ষেত্রে পৃথক সার্ভিস কোড সৃজনসহ মূসক নির্ধারণের বিষয়ে এনবিআরের দিকনির্দেশনা চাওয়া। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় তফসিলে ই-সিমের বিষয়ে আলাদা টেবিল সন্নিবেশিত করা।