মুহাম্মাদ হাসান রাহফি: মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহামারির একটির সম্মুখীন আমরা। জাতি হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য সবার মতো করোনা মহামারির শিকার এবং সবাই নিজ অবস্থান থেকে মোকাবিলা করছি। কভিড-১৯ সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে নিজেকে জাহির করেছে এবং একইসঙ্গে উদ্ভূত হয়েছে একটি বিশাল অর্থনৈতিক সংকট। ফলে আমাদের একে একে মন্দা, খাদ্যাভাব ও অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। অনেক রাষ্ট্রে কিছুটা হলেও এর ছাপ পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের জন্য এ সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। সহজেই অনুমেয়, এই অংশটি কিছুদিনের মধ্যেই কর্মহীনতার দরুন বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়বে। প্রাথমিকভাবে খাদ্যের অভাব অনুধাবন করা না গেলেও লকডাউন উঠে যাওয়ার পর তা প্রকট হওয়ার শঙ্কা অনেকাংশে বেশি। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, খুব শিগগির হয়তো আমরা একটি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে চলেছি। তবে এই মুহূর্তে এ রকম শঙ্কা কিছুটা কম।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক মহামারির পাশাপাশি আঞ্চলিক দুর্যোগ মোকাবিলাও করছে। সম্প্রতি করোনা মহাদুর্যোগের পাশাপাশি আমাদের আম্পানের মতো দুর্যোগকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আম্পানের আঘাতে দেশব্যাপী আমাদের কৃষির অনেক বড় একটা ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে উপকূল এলাকায় বাঁধ ভেঙে জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে মাছের ঘের এবং ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। আশঙ্কার বিষয় এই জোয়ারের লবণাক্ত পানি উপকূলীয় কৃষিজমির চাষের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করবে, অনেক ক্ষেত্রে চাষের অনুপযোগী হয়ে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় আকস্মিক টর্নেডোর দেখা মিলছে। তাতে কয়েক মিনিটের তাণ্ডবে একটি অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ফসলি জমি ও ফলের বাগান থেকে শুরু করে এমনকি পোলট্রি ফার্ম ও গবাদি পশুর খামারের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। ভবিষ্যতে ঘনঘন এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। ফলে আমাদের কৃষি খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তায় যে ঘাটতি দেখা দেবে, তা মোকাবিলা করতে আমরা কতটুকু প্রস্তুত আছি?
কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র বাংলাদেশের মোট খাদ্যচাহিদার সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করে আমাদের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান হাতিয়ার আমাদের স্থানীয় কৃষি খাত। এতক্ষণ আমরা যে আশঙ্কার কথা বলছিলাম, তার সমাধান করতে পারে একটি টেকসই কৃষিব্যবস্থা। আমাদের নীতিনির্ধারকরাই একমাত্র পারেন এই টেকসই কৃষিব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করতে। এর পেছনে অনেক পরিকল্পনা এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের সব নাগরিকে খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি একটি টেকসই কৃষিব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কিছু নীতিগত প্রস্তাবনা তুলে ধরছি:
কৃষিতে সুষম ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ বৃদ্ধি: কৃষিতে স্বাধীনতার পর থেকেই অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ হয়ে আসছে। এ খাতে বরাবরের মতো রাষ্ট্র ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা রয়েছে। কৃষি ব্যাংকের ঋণ প্রদান কার্যক্রমে সব সময় প্রান্তিক কৃষক অবহেলিত থেকেছে। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে একটি টেকসই কৃষিব্যবস্থা এবং খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানে একটি সুষম ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সরকার সম্প্রতি যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা করেছে, তার সম্পূর্ণ অংশ প্রান্তিক কৃষকের মাঝে সুষম বণ্টনের প্রস্তাব দিচ্ছি।
এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এই অর্থায়ন করতে বলা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে প্রান্তিক কৃষকদের এই অর্থ পাওয়ার কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা নেই। সার্কুলার অনুযায়ী একক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করতে পারবে বলা হয়েছে, কিন্তু কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী প্রান্তিক কৃষক এত বড় অর্থ ঋণ পায় না। এতে প্রতীয়মান হয়, প্রান্তিক কৃষককে এই প্রণোদনার আওতায় আনা হয়নি এবং তারা অবহেলিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা করতে হবে প্রান্তিক কৃষকরা যাতে তার প্রাপ্য ঋণ পায়। প্রান্তিক কৃষককে কীভাবে একক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের অন্তুর্ভুক্ত করা যায়, তার একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা কৃষি মন্ত্রণালয়কে প্রণয়ন করতে হবে।
করোনা সংকটের কারণে সৃষ্ট বেকারত্ব মোকাবিলায় কৃষিতে পরিকল্পিত কর্মসংস্থান তৈরির দিকে জোর দিতে হবে। শিক্ষিত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। তারা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কৃষি বিনিয়োগে ইচ্ছুক হয়, তাহলে তাদের সহজ শর্তে কম সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণদের অভিনব উদ্যোগের অংশীদারিত্বের মাধ্যমেও ব্যাংকঋণ প্রদান করা যেতে পারে। এতে উদ্যোক্তা ৬০ শতাংশ এবং ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের ৪০ শতাংশের যৌথ
মালিকানায় কৃষিঋণ বিতরণ করা যেতে পারে এবং এক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত অর্থ তছরুপ হওয়ার শঙ্কা থাকবে না। যৌথ মালিকানায় শক্তিশালী বিনিয়োগ হবে বলেই বিশ্বাস।
স্থানীয়ভাবে কৃষির পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং কৃষি অবকাঠামো তৈরিতে ঋণ সহায়তা: ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রির জন্য স্থানীয়ভাবে বাজার গড়ে তুলতে হবে এবং পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের একটি শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এসব বাজারের মাধ্যমেই কৃষক স্থানীয় কৃষিকাজের যাবতীয় উপকরণের জোগান দেওয়ার পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলও বিক্রি করতে পারবে। অবশ্যই এই বাজার ব্যবস্থাপনা দলীয় ক্যাডার ও দালাল-ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে হবে।
প্রান্তিক কৃষকদের স্থানীয়ভাবে কৃষি অবকাঠামো তৈরির সুযোগ করে দিতে হবে। এসব অবকাঠামোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষকের নিজস্ব ক্ষুদ্র খাদ্যগুদাম তৈরির সুযোগ করে দেওয়া। সরকারিভাবে এ বছর ১৯ লাখ টন ধান-চাল ক্রয় করার কথা বলা হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার স্বার্থে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকারের কমপক্ষে ২৫ লাখ টন ধান-চাল ক্রয় করা প্রয়োজন। সরকারের যে অংশটুকু বাকি থাকে, সেটুকু কৃষকের নিজস্ব ক্ষুদ্র খাদ্যগুদামের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। এতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে কৃষকের এই নিজস্ব গুদাম তৈরিতে কৃষিঋণ অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষি অবকাঠামোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হিমাগার। প্রতিবছর পর্যাপ্ত হিমাগারের অভাবে এবং স্থানীয় শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের একটা বড় অংশ নষ্ট হয়। এতে প্রান্তিক কৃষক তার কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারে না, পাশাপাশি আর্থিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জেলা পর্যায়ে সরকারি অর্থায়নে পর্যাপ্ত পরিমাণে হিমাগার তৈরি করতে হবে। বেসরকারি পর্যায়েও তৈরি করার জন্য ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশনা দিতে হবে।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেরও যথেষ্ট অভাব আছে কৃষির প্রান্তিক পর্যায়ে। আমাদের প্রান্তিক কৃষক শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে ন্যায্য মূল্য না পেয়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে দেয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। তবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার বিষয়ে কৃষকদের যদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়, তাহলে তারা তাদের পণ্যের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারবে। এতে আমাদের কৃষি খাতে একটি সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
তাছাড়া স্থানীয় বাজার তৈরির কথা বলেছি। এই স্থানীয় বাজার তৈরি হতে পারে প্রান্তিক কৃষক এবং স্থানীয় কৃষি উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। স্থানীয় কৃষি অফিস সম্পূর্ণ বাজার পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। তারা পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে। মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের যে জাল তৈরি হয়েছে, তা ধ্বংস করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যদি একটি বাজার গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেখানে কৃষকের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এতে কৃষি ব্যবসায়ীরা যারা দেশের অন্যান্য প্রান্তে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করবে, তারা নির্ধারিত মুনাফায় ব্যবসা করতে পারবে। সারা দেশের সাপ্লাই চেইন সুরক্ষিত ও সচল রাখতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন ও বাংলাদেশ রেলওয়ে এই বাজার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে অংশগ্রহণ করবে।
কৃষি খাতে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি: আমাদের আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক সরঞ্জাম, যেমন; ভারী হারভেস্টার ও রিপার এবং ট্র্যাক্টরের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সহজ শর্তে যেন কৃষকরা আধুনিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারে, সেজন্য সহজ শর্তে দীর্ঘ মেয়াদের ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারে দক্ষ শ্রমিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও বৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ড্রোনস ও রোবটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আধুনিক কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃষিসংশ্লিষ্ট আধুনিক সরঞ্জাম তৈরিতে গবেষণায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি খাতের সমস্যা সমাধানে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও অনুষদকে যুক্ত করতে হবে।
অরগানিক কৃষিকে প্রান্তিক পর্যায়ে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে। অরগানিক কৃষির জনপ্রিয়তা বাড়াতে যা করতে হয় তা করতে হবে। অরগানিক কৃষির অন্যতম একটি আধুনিক ও জনপ্রিয় চাষ পদ্ধতি হলো ভার্টিক্যাল ফার্মিং। ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু প্রথাগত চাষ পদ্ধতি যথেষ্ট নয়। এই পদ্ধতিতে প্রযুক্তির সমন্বয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই ভার্টিক্যাল ফার্মিংকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে অরগানিক কৃষিপণ্যের জন্য যে স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে, সেখানে এর অন্তর্ভুক্তি খুবই সহজ হবে।
সর্বশেষ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মজুতদারি, কিংবা মানুষের খাদ্য অধিকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। খাদ্য সুরক্ষা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বৃহত্তর লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে জবাবদিহি কার্যকর করতে হবে। এ সংকট জাতিগতভাবে মোকাবিলা করতে হবে এবং একে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাতে আমরা একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হব এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও।
ফ্রিল্যান্স লেখক