Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 8:32 pm

আ.লীগের আমলে সড়কে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলের মধ্যে ১৪ বছরে সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজে ২৯ হাজার কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে ধারণা পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। তাদের হিসাবে টাকার ওই অঙ্ক সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পে মোট বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশের সমান।

গতকাল বুধবার ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে একটি ‘গবেষণা প্রতিবেদনে’ প্রকাশ করা হয়। ‘সড়ক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন মো. মোস্তফা কামাল ও মো. জুলকারনাইন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ঠিকাদারের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমের নীতি নির্ধারণ, সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে এই দুর্নীতি করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সড়ক ও সেতু খাতে সরকারের বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এসব প্রকল্পে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা থেকে ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। একেবারে নিম্ন পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এসব দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের ঘুষ লেনদেনে ৪০ থেকে ৪৩ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়। এখন ত্রিপক্ষীয় সিন্ডিকেট যদি আমরা ভাঙতে না পারি, তাহলে দুর্নীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম সফল হবে না।’”

গবেষণাপত্রটি তৈরিতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের নানা প্রকল্পের তথ্য চাইতে গেলে তা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, যেসব তথ্য প্রকাশযোগ্য সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। তবে বাস্তব কথা হলো, প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে তবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার তো পরিবর্তন হয়নি। তাই রাতারাতি পরিবর্তন আশা করছি না।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তাদের গবেষণা প্রতিবেদন শুধু দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প নিয়ে হয়েছে। তবে বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতেও ‘কম বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এতে দেশীয় আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বিদেশি আমলাতন্ত্রের যোগসাজশ হয়েছে।’”

টিআইবির গবেষকরা বলছেন, এই গবেষণার আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে সমাপ্ত প্রকল্পগুলো ছিল। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরুর সময় ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত।
গবেষণায় সড়ক নির্মাণ, সড়ক উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ, সেতু উন্নয়ন (অনূর্ধ্ব ১৫০০ মিটার) ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ সম্পর্কিত প্রকল্প পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১০টি জোনের ১৩টি সার্কেলের ২১টি বিভাগীয় দপ্তরের (জেলা পর্যায়) আওতাধীন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদের লাইসেন্স ভাড়া নেয়া, কোনো ঠিকাদারের পাওয়া কার্যাদেশ ক্রয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে সাব-কন্ট্যাক্ট নেয়া, প্রতিযোগী ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা বা স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কার্যাদেশের ক্ষেত্রে মোট বরাদ্দের ২ থেকে ৬ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে।

নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ প্রাপ্তি ও ঠিকাদারের বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমাণ ১১ থেকে ১৪ শতাংশ। নির্মাণ কাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতির হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ। দরপত্র লাইসেন্স ভাড়া, কার্যাদেশ বিক্রয়, সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতির হার ২ থেকে ৬ শতাংশ।

ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, কয়েকজন সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। ঠিকাদাররা নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে বা বিভিন্ন উপকরণ কম দেন; সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক, প্রকৌশলীরা এই অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ করে দেন। পাথরের ঘনত্ব কম দেয়া, নিম্ন মানের বিটুমিন ব্যবহার বা কম দেয়া, ট্যাক কোট বিটুমিন না দেয়া, বরাদ্দ থাকলেও বৃক্ষরোপণ, রোড সেইফটি সাইন, আর্থ ওয়ার্ক এবং সার্ফেসিং না করা বা অর্ধসমাপ্ত রাখা হয়েছে।
টিআইবি বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা ‘সরাসরি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য পাওয়ায়’ নিম্নমানের কাজ করা বা প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির জন্য তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না।

ইজিপি’র তথ্যের বরাত দিয়ে টিআইবি বলেছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) ঠিকাদারি কাজ পেতে জালিয়াতি করায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৫টি ঠিকাদার কোম্পানিকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তবে ২৬টি কোম্পানির নিষেধাজ্ঞার ওপর উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ দেন। আবার ঠিকাদারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই।
কিছু ঠিকাদারের ‘রাজনৈতিক প্রভাব ও উচ্চপর্যায়ে যোগসাজশ’ থাকার কারণে সওজের কর্মকর্তা ঠিকাদারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না বলেও ধারণা পেয়েছে টিআইবি।

গত পাঁচ বছরে সমাপ্ত প্রকল্পগুলোর ৩৮ দশিমিক ৮ শতাংশ চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ হয়েছে। এছাড়া ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ প্রকল্প পাঁচ বছরের বেশি সময় নিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং একটি প্রকল্প শেষ করতে সর্বোচ্চ ১৭ বছর লেগেছে বলে তাদের গবেষণায় ওঠে এসেছে।