বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তাপ সময় বিরাজ করছে এখন। কান পাতলেই কিংবা পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা। বর্তমানে চলমান বিশ্বের ভূরাজনীতিতে অন্যতম বিষয় হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন সংকট। ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। রাশিয়ার পরে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হচ্ছে ইউক্রেন। মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদনের হিসেবে এটি ইউরোপের দরিদ্রতম রাষ্ট্র। কৌশলগতভাবে কিয়েভ পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কয়েকটি কারণ পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৪ সালে যখন রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পুতিন-সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্রোহীরা শুধু যেটুকু এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে, শুধু সেটাই দাবি করছে না, তারা পুরো দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করছে। যুদ্ধ বন্ধে একটি আন্তর্জাতিক মিনস্ক শান্তি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু লড়াই তাতে থামেনি। আর এ কারণেই রাশিয়ার নেতা বলছেন, ওই অঞ্চলে তিনি তথাকথিত শান্তিরক্ষী পাঠাচ্ছেন। বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে ২০১৫ সালে এ চুক্তি হয়েছিল। যেখানে প্রধান শর্ত ছিল, পূর্ব ইউক্রেন থেকে সামরিক স্থাপনা, সামরিক সরঞ্জাম ও ভাড়াটে সেনাদের সরিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার কথা বলা হয়। অঞ্চলগুলোতে নিজস্ব পুলিশবাহিনী ও স্থানীয় বিচারব্যবস্থা নিয়োগের কথাও উল্লেখ হয় চুক্তিতে। তবে সেসব চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি কিয়েভ। তাছাড়া ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যুক্ত হতে না পারে সেটিও এ সংকটের অন্যতম একটি কারণ। ন্যাটো হচ্ছে ইউরোপের সামরিক একটি জোট সংস্থা। যেখানে সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৩০টি দেশ। রাশিয়ার দাবি ইউক্রেন হচ্ছে প্রাচীন রুশ অঞ্চল। রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ানরা এই জনগোষ্ঠী। এসবের কারণই রাশিয়া ও ইউক্রেন সংকটের মূল সূত্রপাত। ফলস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো ইউরোপীয় দেশ অন্য একটি ইউরোপীয় দেশে হামলা চালিয়েছে।
প্রতিটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি ওই দেশের সংবিধান দ্বারা গঠিত হয়। তেমনি আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতিও সংবিধান দ্বারা প্রণীত। আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বলা হয়েছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। পররাষ্ট্রনীতি বৈশ্বিক পর্যায়ে দেশের অবস্থান, কাঠামোগত ভিত মজবুত করে। পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বিশ্বে একটি দেশের সঙ্গে অন্য একটি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিশেষ লক্ষ্য নির্ধারণ করে পররাষ্ট্রনীতি। তাছাড়া একটি দেশের অন্য একটি দেশের সামগ্রিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থায় কেমন আচরণ করবে তা ঠিক করে পররাষ্ট্রনীতি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি হিসেবে বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি ক্ষুদ্র দেশ, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’।
বাংলাদেশ থেকে ইউক্রেন এর দূরত্ব পাঁচ হাজার মাইল দূরবর্তী হলেও রাশিয়া ও ইউক্রেন সংকটের আঁচ পড়েছে বাংলাদেশেও। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মিত্র সব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কের দরুন রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনের মিত্রদেশগুলো এ সংকটে বাংলাদেশকে তাদের পাশে চাইছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনীতিক সাফল্য বেশ প্রশংসনীয় বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে দ্রুতবর্ধনশীল দেশ হিসেবে ইতোমধ্যে নিজেদের জানান দিয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ভূখণ্ডের পাশাপাশি ইউরোপেও বাংলাদেশের অর্থনীতিক কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো বাড়ছে। ক্রমাগত উন্নয়নকর্ম বহির্বিশ্বে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের দেশের প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে ঢাকা-মস্কোর সম্পর্ক এখন বেশ শীতল এবং কিয়েভসহ বাকি মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কও সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এই যুদ্ধে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতার অবস্থান আহ্বান জানিয়েছে। অপরদিকে ঢাকাকে সরাসরি পাশে চায় ইউক্রেনের মিত্র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে সুর মিলিয়েছে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এটি প্রত্যাশিত যে, এ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের অবস্থান পরিষ্কারভাবে নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমথর্ন দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে সমর্থন জানিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করেছিল রাশিয়া। তাছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রকল্প কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের মিত্র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও আমাদের দেশের সম্পর্ক বেশ ভালো বিধায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি অনেক শক্তিশালী বিরাজ করছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে রাশিয়ার ও ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করাই শ্রেয় হবে। এতে দুই দেশের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক শীতল থাকবে। অবস্থার অবনতি ঘটবে না। উপরন্তু পশ্চিমা মহলে দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুন্নু হওয়ার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকাজ ত্বরিত গতিতে বেগবান হবে।
শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী