ইউনাইটেডে অগ্নিকাণ্ড: ক্ষতিপূরণের আদেশের কার্যকারিতা থাকছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুন লেগে কভিড-১৯ ইউনিটের পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ, বিচারিক তদন্ত চেয়ে করা রিট আবেদনগুলো নতুন করে হাইকোর্টের রিট বেঞ্চে উপস্থাপন করতে বলেছে আপিল বিভাগ। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের আর কার্যকারিতা থাকছে না বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেয়। আদালত আদেশে বলেছে, আবেদনকারীদের স্বাধীনতা আছে হাইকোর্টের যে কোনো রিট বেঞ্চে তা উপস্থাপন করার। আইন অনুসারে হাই কোর্টের স্বাধীনতা রয়েছে যে কোনো আদেশ দেওয়ার।

ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, মোস্তাফিজুর রহমান খান ও তানজীব উল আলম। রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অনীক আর হক, হাসান এম এস আজিম, মুনতাসির আহমেদ।

ইউনাইটেড হাসপাতালের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান পরে বলেন, আপিল বিভাগ আমাদের আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন এই বলে যে, চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যারা রিট আবেদনকারী, তারা নিয়মিত বেঞ্চে রিট আবেদন উপস্থাপন করতে পারবেন শুনানির জন্য। নিয়মিত বেঞ্চ এই রিট আবেদনের উপরে আইনানুগভাবে যে আদেশ উপযুক্ত মনে করবে, সে আদেশ দিতে পারবে। হাই কোর্টের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগে চেম্বার আদালতের স্থগিতাদেশের কোনো প্রভাব পড়বে না।

মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, তার মানে হচ্ছে, ইউনাইটেড হাসপাতালকে আপাতত ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হচ্ছে না। কারণ হাই কোর্টের ভার্চুয়াল একক বেঞ্চের আদেশের কোনো কার্যকারিতা থাকছে না। রিটকারী পক্ষের আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিনও মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ যে আদেশ দিয়েছিল, আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে তা কার্যকারিতা হারিয়েছে।

তিনি বলেন, ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়ার আদেশটি হয়েছিল ভার্চুয়াল একক বেঞ্চে। ওই বেঞ্চ যেহেতু রুল ইস্যু না করে অন্তবর্তী আদেশ দিয়েছে, তাই বিবাদীপক্ষের যুক্তি ছিল, রুল না দিয়ে একক বেঞ্চ কোনো অন্তবর্তী আদেশ দিতে পারে কিনা। পরে আপিল বিভাগ বিবাদীদের (ইউনাইটেড হাসপাতাল) আবেদন নিষ্পত্তি করে দিয়ে আমাদের (রিট আবেদনকারীদের) বলেছে নিয়মিত বেঞ্চে রিট উপস্থাপন করতে। নিয়মিত বেঞ্চ যে কোনো আদেশ দিতে পারবে। ফলে হাই কোর্টের আগের আদেশটির কার্যকারিতা থাকছে না।

রিটকারী পক্ষের আরেক আইনজীবী হাসান এম এস আজিম বলেন, ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি ছাড়াই ৩০ লাখ টাকা করে দিতে বলেছিল। আর ইতোমধ্যে নিয়মিত বেঞ্চ চালু হয়ে গেছে। তাই হাইকোর্টের নিয়মিত রিট বেঞ্চে আবেদনটি নতুনভাবে উপস্থাপন করে আবার শুনানি করতে বলেছে আপিল বিভাগ। আদালত বলেছে, যদি এই রিট আবেদনগুলো হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে আপিল বিভাগের আদেশের কোনো প্রভাব থাকবে না। রুল জারিসহ যে কোনো আদেশ দেওয়ার স্বাধীনতা উচ্চ আদালতের রয়েছে।

এ সংক্রান্ত চারটি রিটের আইনজীবীরা বলেছেন, হাইকোর্টের নিয়মিত বেঞ্চে তারা নতুন করে আবেদন উপস্থান করবেন। আগুন লেগে কোভিড-১৯ ইউনিটের পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে ইউনাইটেড হাসপাতালকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমঝোতায় আসতে না পারায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ১৫ জুলাই এ আদেশ দেয়।

সে আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত ২১ জুলাই চেম্বার আদালত হাই কোর্টের আদেশটির কার্যকারিতা স্থগিত করে দেয় এবং ইউনাইটেডের আবেদনটি ১৬ অগাস্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য রাখে। গত ২৭ মে রাতে গুলশানের বেসরকারি ওই হাসপাতালের প্রাঙ্গণে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য করা আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লেগে পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে তিনজনের কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিল।

ওই পাঁচজন হলেন- মো. মাহবুব (৫০), মো. মনির হোসেন (৭৫), ভারনন অ্যান্থনি পল (৭৪), খোদেজা বেগম (৭০) ও রিয়াজ উল আলম (৪৫)। ওই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন এবং নিহতদের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত ৩০ মে একটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিয়াজ মুহাম্মদ মাহবুব ও শাহিদা সুলতানা শিলা।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মো. মাহবুব এলাহী চৌধুরীর ছেলে আননান চৌধুরী এবং ভারনন অ্যান্থনি পলের ছেলে আন্দ্রে ডোমিনিক পলও পরে সে রিটে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর গত ২১ জুন রিয়াজুল আলমের স্ত্রী ফৌজিয়া আক্তার ১৫ কোটি ক্ষতিপূরণ চেয়ে আলাদা একটি রিট আবেদন করেন। তাতে এক কোটি টাকা অন্তবর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়।

এছাড়া এ ঘটনার বিচারিক তদন্ত চেয়ে ১ জুন আরেকটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী রেদওয়ান আহমেদ ও হামিদুল মিসবাহ। কেন বিচারিক তদন্ত করা হবে না- সে বিষয়ে রুলও চাওয়া এ রিটে। গত ২ জুন এসব রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ১৪ জুনের মধ্যে ঘটনার প্রতিবেদন দিতে বলে হাই কোর্ট।

এর মধ্যে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে ইউনাইটেড হাসপাতালের গাফিলতির কথা আসে। রাজউক জানায়, করোনাভাইরাসের জন্য আলাদা করে আইসেলেশন ইউনিট করার অনুমতি নেয়নি ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নিলে রোগীদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হত। তাছাড়া হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।

আর ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রতিবেদনে ওই ঘটনাকে স্রেফ ‘দুর্ঘটনা’ বলা হয়। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত ২৯ জুন এক আদেশে হাই কোর্ট ইউনাইটেড হাসপাতালকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করতে বলে। সেই সঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে করা মামলাটির তদন্তও দ্রুত শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ইউনাইটেড হাসাপাতালের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খানের ভাষ্য, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তারা ক্ষতিগ্রস্ত সবার পরিবারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে অর্থ দিতে চেয়েছিল, তাতে রাজি হয়নি চার পরিবার। অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া মনির হোসেনের পরিবার শুধু ২০ লাখ টাকায় সমঝোতায় সম্মত হয়। পরে গত ১৫ জুলাই বিষয়টি হাই কোর্টকে জানানো হলে আদালত ৪ পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে নির্দেশ দেয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০