ইউনাইটেড এয়ারে ফেঁসে গেলেন এনআরবি ব্যাংক চেয়ারম্যান

পলাশ শরিফ: ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার কিনে বিপাকে প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান। অনিয়ম ও মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়াতে তিন বছর আগে পরিচালকের পদ ছেড়েছেন তিনি। এরপর ৩৬ টাকায় কেনা শেয়ার বিক্রি করেছন ছয় টাকায়। তারপরও সংকট কাটছে না। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সাবেক পরিচালক হিসেবে ‘ঋণখেলাপি’ তকমা নিয়ে অস্বস্তিতে আল-হারামাইন গ্রুপের এ কর্ণধার। এ কারণে মাহতাবুর রহমানের এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় লেটার অব গ্যারান্টি দিয়েছিলেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী, পরিচালক মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ও শাহিনুর আলম। চূড়ান্ত তাগাদা ও উকিল নোটিস দেওয়ার পরও ঋণ শোধ না করায় ঋণখেলাপি হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা খেলাপি ছিল কোম্পানিটি। এ কারণে ওই বছরের শেষদিকে একটি এয়ারক্র্যাফট, দুটি এয়ারক্র্যাফট ইঞ্জিন ও দুটি মিনিবাসসহ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বন্ধকী চলতি ও স্থায়ী সম্পদ নিলামে বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়। নোটিসের পর উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। আদালতের আদেশে নিলাম আটকে গেলেও ‘ঋণখেলাপি’ তকমা নিয়ে বিপাকে বেসরকারি এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান। কারণ ‘ঋণখেলাপি’ হয়ে কোনো ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকার সুযোগ নেই।
তথ্যমতে, ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঋণ পরিশোধের জন্য মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানকে দুমাস সময় দিয়ে চূড়ান্ত নোটিস পাঠায় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট ‘নোটিসে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিচালক পদ শূন্য হয়ে যাবে’ বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। মহাব্যবস্থাপক আবু ফারাহ মো. নাসের স্বাক্ষরিত ওই নোটিসের জবাবে ‘ওই ঋণের বিপরীতে লেটার অব গ্যারান্টিতে স্বাক্ষর করেননি’ বলে দাবি করেন মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান। সে সঙ্গে ঋণ সংক্রান্ত ২০১৪ সালের ১১ মার্চের পর্ষদ সভায় অংশ নেননি বলেও দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটিসের কার্যকারিতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের পর ওই বছরের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অপর এক চিঠির মাধ্যমে আগের নির্দেশনা রহিত করে দু’পক্ষের বক্তব্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর জের ধরে তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে এনআরবি ব্যাংক জানায়, ‘তিনি দুবাইয়ে থাকেন। শুধু বোর্ড মিটিংয়ের সময়ে এসে অংশ নেন। মিটিং থাকলে চলতি মাসের শেষদিকে দেশে আসতে পারেন।’
আলাপকালে এনআরবি ব্যাংকের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহমুদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি হওয়ায় উনার চেয়ারম্যান পদে থাকা নিয়ে আইনি জটিলতা হয়েছিল। বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এটি এনআরবি ব্যাংকের বিষয় নয়, আমরাও এর সঙ্গে জড়িত নই। তাই চেয়ারম্যান মহোদয় দেশে এলে উনার সঙ্গে কথা বলাই ভালো। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’
এদিকে ২০১৫ সালের ৪ জুলাই (ওই বছরের ১৭ জুলাই থেকে কার্যকর) মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালকের পদ ছাড়লেও সেটি আইনসম্মত হয়নি বলেও তথ্য মিলেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে ‘ঋণদাতা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া কোনো ঋণগ্রহীতা কোম্পানির কোনো পরিচালকের পদত্যাগ কার্যকর হবে না। কোনো পরিচালক শেয়ার হস্তান্তর বা বিক্রিও করতে পারবেন না’ বলা হলেও মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানের পদত্যাগের বিষয়টি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে অবগত করা হয়নি। আর রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) নথিপত্রে তার পদত্যাগপত্র ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর দেখানো হয়েছে। তাই পদ ছাড়লেও তার পদত্যাগের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
অন্যদিকে ‘লেটার অব গ্যারান্টিতে স্বাক্ষর করেননি’ মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ তার স্বাক্ষর জাল করেছে কি না’ এমন প্রশ্নও উঠে। তবে স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না কোম্পানিটি।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ঋণগুলো ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে নেওয়া। এরপর কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। মাহতাবুর রহমান সাহেব ২০১৪ সালের পর্যন্ত জুলাই পর্যন্ত পরিচালক ছিলেন। সে কারণে পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক উনাকে খেলাপি বলছে। উনি লেটার অব গ্যারান্টিতে স্বাক্ষর করেছেন কি না সেটা ব্যাংকই ভালো বলতে পারবে। একইভাবে পরিচালক পদ ছাড়ার বিষয়টি নিয়ম মেনে হয়েছে কি না সেটাও উনার আর ব্যাংকের বিষয়। এসব নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। এখন আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি।’
তবে এ বিষয়ে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দায়িত্বশীলরা কিছু বলতে চাননি। ব্যাংকটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গ্রাহকদের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও গ্রাহক ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করি না। তাছাড়া ইউনাইটেড এয়ারের খেলাপি ঋণের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। তাই স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’
সফল প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান আল-হারামাইন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি সত্তরের দশকে সৌদি আরবে পারিবারিক ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশের সুগন্ধিকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সফল প্রবাসী ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখান তিনি। বৈধ চ্যানেলে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠানোর জন্য তিনি ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চারবার বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) মনোনীত হন। তবে সফল এই ব্যবসায়ী ব্যক্তি বাংলাদেশে বিতর্কিত কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে বিনিয়োগ করে বিপদে পড়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে ঋণ নেয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। পরে ইসলামী ব্যাংকও বেসরকারি কোম্পানিটিকে অর্থায়ন করে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ও ব্যবসায়িকভাবে পিছিয়ে পড়ায় দায় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে কোম্পানিটি। বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকেও কোম্পানিটির ঋণ প্রায় ১২০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি সংস্থা-প্রতিষ্ঠানেও দায় রয়েছে কোম্পানিটির। এসব কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ।

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০