ইউনাইটেড গ্রুপ চেয়ারম্যানসহ সাতজনকে দুদকে তলব

নিজস্ব প্রতিবেদক: আলোচিত পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপারসে নাম থাকায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতজনকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সাতজনের মধ্যে কেবল ইউনাইটেড গ্রুপেরই চারজনের নাম রয়েছে। অন্য যে তিনজনকে তলব করা হয়েছে তারাও ব্যবসায়ী। বিদেশে সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার বিষয়ে আগামী ১৬ ও ১৭ জুলাই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক এসএম আখতার হামিদ ভূঞা পৃথক চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের হাজির হওয়ার কথা জানান।
পানামা পেপারসে নাম আসা ইউনাইটেড গ্রুপের চারজন হলেন চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা ও পরিচালক খোন্দকার মইনুল আহসান, আহমেদ ইসমাইল হোসেন ও আকতার মাহমুদ। তাদের ১৬ জুলাই তলব করা হয়েছে। অন্যদিকে প্যারাডাইস পেপারসে নাম আসা তিনজন হলেন, ডব্লিউএমভি লিমিটেডের এরিক জোহান অ্যান্ডারস উইলসন, ইন্ট্রেপিড গ্রুপের ফারহান আকিবুর রহমান ও সেলকন শিপিং কোম্পানির মাহতাবা রহমান। তাদের ১৭ জুলাই তলব করা হয়েছে। আলোচিত পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপারসে যেসব বাংলাদেশির নাম এসেছে, তাদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার বিষয়ে গত মাসে নির্দেশ দিয়েছিলেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।
পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্স বিশ্বের ১৮০টি দেশের রাজনীতিবিদ, সেলিব্রিটি ও বিত্তশালী মানুষের অর্থনৈতিক লেনদেন ও মালিকানাসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যের বিশাল ডেটাবেস। কর দিতে হয় না, কিংবা খুবই নিম্নহারে কর দেওয়া লাগে এমন দেশে বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয় উল্লেখ ছিল ওই পেপারে।
২০১৬ সালে পানামা পেপার্স এবং গত বছরের নভেম্বরে প্যারাডাইস পেপারসে অনেক বাংলাদেশির নাম এলেও সে বিষয়ে কোনো সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। প্যারাডাইস পেপারসে যেসব বাংলাদেশির নাম এসেছে তারা মাল্টায় নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন এবং তাদের কয়েকজন বিদেশের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন বলে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার বাংলাদেশে ব্যবসা করা বিদেশিরা এদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে সেই দেশে বিনিয়োগ করেছেন বলে ফাঁস হওয়া নথিতে উঠে এসেছে। করফাঁকি ও অর্থপাচার-সংক্রান্ত সাড়াজাগানো পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে এ পর্যন্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ ৩৪ বাংলাদেশি ও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে।
প্যারাডাইস পেপারসে নাম থাকা ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেনÑধানমন্ডি এলাকার পৃথক ঠিকানা ব্যবহার করা জুলফিকার আহমেদ ও কে এইচ আসাদুল ইসলাম, মুসা বিন শমসের, বনানীর ঠিকানা ব্যবহারকারী মাহতাবা রহমান, সাভারে অবস্থিত ঢাকা ইপিজেডের ব্যবসায়ী শাহনাজ হুদা রাজ্জাক ও ইমরান রহমান, বারিধারার ঠিকানা ব্যবহার করা ব্যবসায়ী মো. ফজলে এলাহী চৌধুরী ও আমানউল্লাহ চাগলা। ২০১০ সালের ৪ মে নিবন্ধিত হওয়া ভেনাস ওভারসিজ হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেডে মুসা বিন শমসেরের শেয়ার রয়েছে। জুলফিকার আহমেদ বিনিয়োগ করেছেন খালেদা শিপিং কোম্পানি লিমিটেডে। এর নিবন্ধন হয় ১৯৯৯ সালের ২৫ মে। আসাদুল টাকা রেখেছেন ইনট্রেপিড ক্যাপিটাল লিমিটেড ও ইনট্রেপিড গ্রুপ লিমিটেডে, তার দুটো কোম্পানিরই নিবন্ধন হয়েছে ২০১৫ সালের ২০ মার্চ। মাহতাবার কোম্পানির নাম সেলকোন শিপিং কোম্পানি লিমিটেড, নিবন্ধন ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট।
ইপিজেডের ঠিকানা দেওয়া ইমরান ও শাহনাজ দুজনই প্রিয়ম শিপিং লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির পরিচালক। সাউদার্ন আইস শিপিং ও ওসান আইস শিপিং নামে দুটি কোম্পানির পরিচালক হিসেবেও আছেন ইমরান।
২০১৬ সালের ১০ জুন নিবন্ধিত ডাইনামিক এনার্জি হোল্ডিং লিমিটেডের পরিচালক ফজলে এলাহী। বারিধারা ডিওএইচএসের ঠিকানা দেওয়া আমানউল্লাহ চাগলা অর্থ রেখেছেন পদ্মা টেক্সটাইলস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি খুলে। এর নিবন্ধন হয় ২০০৯ সালের ৫ মার্চ। এছাড়া আবাসিক ঠিকানা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও লালখান বাজার এলাকা উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদ এ মালেক এবং মোহাম্মদ এ আউয়াল। তারা অর্থ রেখেছেন শামস শিপিং, কুয়ামার শিপিং ও মারজান শিপিং লিমিটেড নামের তিনটি কোম্পানিতে, যেগুলো নব্বইয়ের দশকে নিবন্ধিত।
নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার আবাসিক ঠিকানা ব্যবহারকারী তাজুল ইসলাম তাজন ও তুহীন ইসলাম সুমন মাল্টায় বিনিয়োগ করেছেন জেক্সিমকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে। এ কোম্পানির নিবন্ধন হয় ২০০৯ সালের ৫ জুন। ইউসুফ খালেক নামের একজন বাংলাদেশি আবাসিক ঠিকানা ব্যবহার করেছেন ইতালির পাদোভা শহরের। এর বাইরেও বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে। পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে সিগমুন্ড গুনলাগসনকে। ২০১৬ সালে একই পরিণতি হয়েছিল স্পেনের ভারপ্রাপ্ত শিল্পমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল সোরিয়ারও।
অর্থপাচার-বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি (৮৯৭ কোটি ডলার) পাচার হয়। তার আগে ১০ বছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে ২০১৪-১৫ মেয়াদে বাংলাদেশ থেকে ৬১ দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ।
২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল মোসাক ফনসেকা নামে পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস হয়। এ নিয়ে বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নথিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নিকটাত্মীয়দের নাম আসে। এছাড়া সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহমান আল সৌদ, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের এক ছেলে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দুই ছেলে ও এক মেয়ের নাম উঠে আসে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পাশাপাশি ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি, ভারতের খ্যাতিমান অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও তার পুত্রবধূ অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাইয়ের নামও উঠে আসে।
অপরদিকে ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্যারাডাইস পেপারসের প্রায় ২৫ হাজার নথি প্রকাশ হয়। সেখানে ফাঁস হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেক ব্যক্তির গোপন তথ্য। তালিকায় ১২০ রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। নথিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মতো ব্যক্তির নাম রয়েছে। এখানে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০