জাকারিয়া পলাশ: ‘আস্থা রাখুন শুধু বিশ্বের এক নম্বর ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্র্যান্ডের ওপর’। এক সপ্তাহ আগেও এমন বিজ্ঞপ্তি সম্প্রচার করে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করেছে ইউনিলিভার। নিজেদের বিশ্বসেরা দাবি করলেও ইউনিলিভারের পিউরইটের মধ্যে এবার পাওয়া গেছে তেলাপোকা ও পিঁপড়ার মতো কীটপতঙ্গ। বিষয়টি স্বীকার করেছে ইউনিলিভার কর্র্তৃপক্ষ। এর আগে পণ্যটির জার্ম কিল কিটের (জিকেকে) মান নিয়ে অভিযোগসহ ফ্রি ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ ছিল।
সর্বাধিক বিশুদ্ধ পানির আশ্বাস দিয়ে পিউরইটে এখন কীটপতঙ্গ ঢুকে পড়ার ঘটনাকে বিরল ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে ইউনিলিভার। যদিও পিউরইটে নিয়মিতই পিঁপড়া ঢুকছে বলে গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন। তবে এ নিয়ে কাস্টমার কেয়ারে অভিযোগ করেও কার্যত কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে ক্ষুব্ধ ভোক্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বহুজাতিক কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ই-মেইল বার্তায় জানানো হয়, ‘আমরা আমাদের মূল্যবান গ্রাহকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিই। এটা একটা বিরল ঘটনা (রেয়ার কেস), যা আমরা প্রথমবারের মতো কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে পেয়েছি। তবুও গ্রাহকের পক্ষ থেকে পিউরইটের বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে কোম্পানির হেল্পলাইনে কল করার অনুরোধ করা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টাই হেল্পলাইনে কল করা যাবে। পিউরইটের হেল্পলাইন নম্বর হচ্ছে ০৯৬১৩১০৫১০৫। অভিযোগ পেলে আমাদের কারিগরি দল (টেকনিক্যাল টিম) সমস্যার সমাধান করবে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর এলাকার আবদুল্লাহ আল মামুন খান দীর্ঘদিন ধরেই পিউরইট ব্যবহার করছেন তার বাসায়। সম্প্রতি দেখা যায়, তার পিউরইট যন্ত্রের ফিল্টারের মধ্যে তেলাপোকা ও পিঁপড়া ঢুকে পড়ছে। এ নিয়ে তিনি কোম্পানিতে অভিযোগ (নম্বর সি-০৩৪২৭৭৮৯২৪) করেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে তাকে এসএমএস দিয়ে জানানো হয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য টেকনিক্যাল টিমের কর্মীরা পৌঁছে যাবেন। তবে এজন্য তাকে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে।
পরে টেকনিক্যাল টিমের এক কর্মী তার বাসায় গিয়ে পিউরইট যন্ত্রের ভেতর থেকে তেলাপোকা পরিষ্কার করেন। এজন্য তার কাছ থেকে ৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়। কিন্তু তারপর থেকে ওই যন্ত্রের পানি ঠিকমতো পরিশোধন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে অভিযোগকারী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পিউরইট যন্ত্র থেকে তেলাপোকা উদ্ধারের পর অনবরত পানি পড়ছে যন্ত্র থেকে। আমি সেটি ব্যবহার করতে পারছি না। এ নিয়ে আবার আমি হেল্পলাইনে ফোন করে অভিযোগ করি। আমি তাদের জানিয়েছি কোম্পানির লোকেরা অদক্ষ। তাদের ভুলের কারণে এটি ঠিকমতো কাজ করছে না। এখন এটি ঠিক করার জন্য গ্রাহক হিসেবে আমি সার্ভিজ চার্জ দেব না। তার পর থেকে কোম্পানির কোনো লোক আমার বাসায় আসেনি। আমি এখন বিকল্প উপায়ে পানি বিশুদ্ধ করছি।’
এ বিষয়ে মিরপুর এলাকার টেকনিক্যাল টিমের সদস্য নাজমুল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তেলাপোকা পাওয়া গেছে; কিন্তু সাধারণভাবে যন্ত্রের মধ্যে তেলাপোকা ঢোকার কথা নয়, কিছু ক্ষেত্রে ঘটে। যন্ত্রের পাশে বাচ্চাদের ওষুধ বা মিষ্টিজাতীয় কিছু রাখা ছিল। সেজন্য এমনটি হয়েছে।’ তবে যন্ত্রের বাইরে মিষ্টি জিনিস থাকলে ভেতরে পিঁপড়া কেন ঢুকবে তা জানা যায়নি ওই কর্মীর কাছ থেকে।
রাজধানীর রামপুরার সাইদুর রহমান নামে এক গ্রাহক জানান, কোম্পানির কর্মীরা রাস্তায় পথ রোধ করে একদিন বিশুদ্ধ পানির জন্য পিউরইট কেনার পরামর্শ দেয়। সেদিন অর্ডার দিয়েছিলাম। পরে পিউরইট যন্ত্রটি বাসায় দিয়ে যায় কোম্পানির কর্মীরা। তার পর থেকে নানা সমস্যায় রয়েছি। প্রথম কয়েক মাস ভালো চলেছিল। এখন মাসে মাসে এক হাজার ১৫০ টাকা দিয়ে নতুন যন্ত্রাংশ (জিকেকে) কিনতে হয়। সম্প্রতি দেখছি ছাকনির ভেতরে ঢুকে পড়ছে পিঁপড়াসহ বিভিন্ন পতঙ্গ। ফলে এখন আর পিউরইট ব্যবহার করছি না।’
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৬ ও ১১ ফেব্রুয়ারি শেয়ার বিজে পিউরইটের বিষয়ে দুটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘পিউরইটের মান নিয়ে প্রশ্ন, গ্রাহককে ঠকাচ্ছে ইউনিলিভার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, ‘সদ্য কেনা পিউরইটের পানিতে যে স্বাদ পাওয়া যায়, ছয় মাস পর তার জিকেকে প্যাকেজ বদলে নতুন জিকেকে ব্যবহার করলে পানিতে সে স্বাদ থাকছে না। তাছাড়া কোম্পানির বিজ্ঞাপনে জিকেকের পানি বিশুদ্ধকরণের সক্ষমতার যে সীমা (দেড় ও তিন হাজার লিটার) বলা হয় বাস্তবে তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কিছুদিন পরপরই যন্ত্রাংশ বদলাতে গিয়ে ব্যয়ের চক্রের মধ্যে পড়তে হচ্ছে গ্রাহককে।’
এ প্রসঙ্গে ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোনো ভোক্তা প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পাওয়ার আধিকার রয়েছে। ভোক্তা অধিকার আইনে এ অধিকার দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারকারীরা প্রতিশ্রুতির চেয়ে কম সেবা পেলে কিংবা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারিত হলে প্রমাণসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করতে পারেন। এ বিষয়ে অভিযোগ করা ভোক্তার দায়িত্ব। ভোক্তারা এ অভিযোগ করলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর তা অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেবে।’
পরে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘হোম ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ ইউনিলিভার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুরুতে ফ্রি হোম ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিউরইট বিক্রি করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা হয়েছিল। পরে সে প্রতিশ্রুতি না রেখে প্রতিবার হোম ডেলিভারির জন্য ৫০ টাকা করে চার্জ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিটি। শেয়ার বিজে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদনের পর গ্রাহকরা নানা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আবদুল হান্নান নামের এক গ্রাহক মন্তব্য করেছেন, কোম্পানিটি আইটেম বিক্রির নানা ফাঁদ পাতছে। সার্ভিস হোল্ডারকে ১০০ বার ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের সাপ্লাই চেইন বিশ্বের বহু দেশে বিস্তৃত। বাংলাদেশেও গৃহস্থালি থেকে শুরু করে টয়লেট পর্যন্ত নানা পণ্য রয়েছে এর। ২০১০ সাল থেকে একচেটিয়াভাবে বাজারে রয়েছে কোম্পানিটির পিউরইট নামে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র। ব্যাপক মার্কেটিং করে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা দিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ১০ লাখ গ্রাহক সৃষ্টি করেছে তারা। কোম্পানিটি পিউরইট বিক্রির জন্য সম্প্রতি নতুন অফার ঘোষণা করেছে। আগামী আগস্ট পর্যন্ত ১০ শতাংশ ছাড়ে যন্ত্রটি গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার অফার দিয়ে মুঠোফোনে মেসেজ পাঠাচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি গ্রামাঞ্চলে কিস্তিতে পিউরইট বিক্রির জন্যও উদ্যোগ নিয়েছে ইউনিলিভার।