নিজস্ব প্রতিবেদক: একুশ বছর আগে চট্টগ্রামের সোনাকানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনকে হত্যার দায়ে সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যানসহ ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। চট্টগ্রামের বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক একেএম মোজাম্মেল হক গতকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নেজাম উদ্দিনসহ ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাশাপাশি পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের মধ্য থেকে চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর রাত সোয়া ১২টায় সাতকানিয়া উপজেলার মির্জাখীল দরবার শরিফের ওরস চলাকালে সোনাকানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনকে (৪৫) গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় তার স্ত্রী সৈয়দা রওশন আকতার বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় এ হত্যা মামলা দায়ের করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেনÑনেজাম উদ্দিন, জাহেদ, আবু মো. রাশেদ, মানিক, জিল্লুর রহমান, মো. রফিক, ফারুক আহমেদ, জসিম উদ্দিন, বশির আহমদ ও তারেক। তাদের মধ্যে শেষ দুজন পলাতক।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন মো. ইদ্রিস (বাবার নাম ইব্রাহিম), হারুণ, মো. আইয়ুব, মোরশেদ আলম এবং ইদ্রিস (বাবার নাম সাহেব মিয়া)। তাদের মধ্যে শেষ তিনজন পলাতক। খালাস পাওয়া চারজন হলেন তাহের, শায়ের, মোস্তাক আহমেদ ও আবদুল মালেক। নিহত আমজাদ হোসেনের ভাতিজা আইনজীবী আবদুল আলম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর বিচার পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট। আসামিরা বারবার নানাভাবে বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার চাচা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। তিনি দুবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়, ডাকাত ধরিয়ে দেওয়ায় এবং ডাকাতরা পুলিশের কাছে আসামিদের নাম বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আমার চাচাকে হত্যা করে।’
এদিকে সকালে রায় ঘোষণার আগে নেজাম উদ্দিনের অনুসারীরা আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নিলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। দুই পক্ষের অনুসারীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি সেøাগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে নেজাম উদ্দিনের অনুসারীরা সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে যায়। বাকবিতণ্ডার মধ্যে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চেয়ারম্যান আমজাদ ছিলেন চার মেয়ে ও এক ছেলের জনক। সোনাকানিয়ায় মির্জাখীল দরবার শরীফের উত্তর পাশে তার বাড়ি।
বাদীর আইনজীবী মো. আবুল মাজন মাসুম বলেন, ‘দরবারের পূর্ব পাশে স্থানীয় প্রভাবশালী লুৎফুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি। এলাকার মানুষের ওপর লুৎফুর রহমানের ‘অন্যায়-অত্যাচারের’ প্রতিবাদ করায় তিনি আমজাদ হোসেনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। এছাড়া ১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় পুলিশের যৌথ অভিযানে ডাকাত গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করেন আমজাদ হোসেন। সেই ডাকাতরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে নেজাম উদ্দিন ও বশির আহমদের নাম বলে। ডাকাতি নির্মূলে ভূমিকা নেওয়ায় এবং এলাকায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় লুৎফুর রহমান ও নেজাম উদ্দিনরা মিলে আমজাদ হোসেনকে খুন করে।’
পরে লুৎফুর রহমান চৌধুরী মারা গেলে মামলা থেকে তার নাম বাদ পড়ে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নেজাম উদ্দিন ঘটনার সময় ‘বিএনপির রাজনীতিতে’ সম্পৃক্ত থাকলেও পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয় বলে আমজাদের পরিবারের দাবি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি বশির আহমদও সাতকানিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। শুরুতে পুলিশ মামলাটি তদন্ত করলেও পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে তদন্তভার ন্যস্ত হয়।
২০০০ সালের ২২ ডিসেম্বর সিআইডি ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আদালত আসামিদের বিচার শুরু করেন। একাধিকবার আদালত পরিবর্তনের মধ্যেই ২০১৯ সালের মার্চে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। চলতি বছরের শুরুতে মামলাটি আবার বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসে।
১১ নভেম্বর অধিকতর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। নেজাম উদ্দিনসহ সেদিন উপস্থিত ১০ আসামির জামিন বাতিল করে আদালত তাদের কারাগারে পাঠান। এরপর ২৬ নভেম্বর ও ৭ ডিসেম্বর রায় ঘোষণার দিন থাকলেও তা পিছিয়ে যায়। সবশেষ রোববার ১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিলেন আদালত।