রোহান রাজিব: দেশের রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) অর্থ ফেরত দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ইডিএফ ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে। যার ফলে এসব ঋণের অর্থ ফেরত আসছে না। সদ্য পতন হওয়া শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ থেকে শুরু করে ব্যাংক খাতে ঋণ কেলেঙ্কারিতে আলোচিত ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ ও এসবি পুণ্য গ্রুপ ঋণের নামে ইডিএফ ঋণ আত্মসাৎ করেছে। ঋণ নিয়ে সময়মতো ফেরত দেয়নি আকিজ গ্রুপও। এর বাইরে আরও অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ইডিএফ ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে। আবার যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ দেয়া হয়েছিল, ডলার সংকটের কারণে তাদের হিসাব থেকেও তা সমন্বয় করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ইডিএফ ঋণের বড় একটা অংশ মেয়াদোত্তীর্ণ তথা খেলাপি পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন বলছে, ইডিএফ তহবিলের সুবিধাভোগী শীর্ষ ৪০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ৬০০ মিলিয়ন বা ৬০ কোটি ডলারের মতো আটকে রয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ঢাকার এখতিয়ারভুক্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে প্রায় ৫৬ কোটি ডলার, যার সিংহভাগই ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ ও বেক্সিমকো গ্রুপের। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের এখতিয়ারভুক্ত ২০ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে ৩ কোটি ডলারের মতো।
ইডিএফ ঋণ সময়মতো ফেরত না আসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির অভাবকে দায়ী করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ এই ঋণে ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পূর্বানুমোদন দরকার হয়। অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানের কারণে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা সহজেই এই ঋণের সুবিধাভোগী হয়েছেন। আবার তাদের ঋণগুলো তদারকির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দমিয়ে রাখতেন তিনি। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য কাজী ছাইদুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগটির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ইডিএফের ওভারডিউ অনেকদিন ধরে। গ্রাহকদের কেউ কেউ প্রভাবশালী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চাপ দিয়ে এসব ডলার ফেরত আনার সাহস দেখানো হয়নি। আবার ব্যাংকগুলোতে ডলার না থাকার কারণে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকেও সমন্বয় করা যায়নি। এখন নতুন সরকার আসছে। তারা চাইলে চাপ দিয়ে হলেও এসব ডলার ঋণ আদায় করা যাবে।
পণ্য রপ্তানির জন্য কাঁচামাল আমদানিতে রপ্তানিকারকদের ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কম সুদে ডলারে ঋণ দিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১৯৮৯ সালে গঠিত হয় ইডিএফ। এই ঋণ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ২৭০ দিন সময় পান উদ্যোক্তারা। কিন্তু আলোচ্য প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো তা পরিশোধ করেনি। সূত্রগুলো বলছে, অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে বেশির ভাগ ইডিএফ ঋণ বের করে নেয়ায় তা সময়মতো ফেরত আসছে না। বিশেষ করে ঋণের বিপরীতে পণ্য রপ্তানি হলো কিনা বা সেই রপ্তানির বিপরীতে আয় দেশে প্রত্যাবাসন হলো কি না, তা নিশ্চিত না হয়েই গুটিকয়েক গ্রাহককে বারবার ইডিএফ সুবিধা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে ইডিএফ সুবিধার অপব্যবহার করা হয়েছে। আর সময়মতো রপ্তানি না হওয়ায় ও রপ্তানি মূল্য দেশে না আসায় ঋণ ফেরত পাওয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে এই ঋণের বিপরীতে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকুলে টাকায় ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি করেছে ব্যাংকগুলো।
জানা গেছে, কভিডে প্রকোপ শুরুর পর ২০২০ সালের এপ্রিলে ইডিএফের আকার ৩৫০ কোটি ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার করা হয়। এরপর দফায় দফায় আরও বাড়িয়ে ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা হয়। তবে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডলার-সংকট শুরু হওয়ার পর ইডিএফ ঋণ নিরুৎসাহিতে সুদহার বাড়ানো হয়। এরপর গত বছরের মার্চে নানা নিয়মকানুন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত আইএমএফের দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের শর্ত পূরণে গত বছরে মাঝামাঝিতে এই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ বন্ধ রাখা হয়। তবে প্রভাবশালীদের তদবিরে এখন আবার সেটি চালু করা হয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে এই তহবিলের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ২৬০ কোটি ডলারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও অফিশিয়াল বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
লুটপাটে এগিয়ে বিসমিল্লাহ ও ক্রিসেস্ট গ্রুপ : অনিয়ম ও কারসাজি করে জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদের ও তার ভাই জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ। তাদের তিনটি প্রতিষ্ঠানও ইডিএফ ঋণের সুবিধাভোগী। জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে রপ্তানি না করেও ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়েছে এসব ঋণ বের করে নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ইডিএফ ঋণ আটকে আছে প্রায় ১৭ কোটি ডলার।
এ ঋণের সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যারের নামে ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার, ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টসের নামে ৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার ও রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যারের নামে ৫ কোটি ১৭ লাখ ডলার বের করে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ভুয়া রপ্তানি বিল তৈরি করে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতাসহ পাঁচটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া আলোচিত গ্রুপ বিসমিল্লাহ গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান ইডিএফ ঋণেরও সুবিধাভোগী। এগুলো হলো- বিসমিল্লাহ টাওয়াল, হিন্দোলওয়ালী টেক্সটাইল, আলফা কম্পোজিট টাওয়েল ও শাহরীশ কম্পোজিট টাওয়েল। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতাসহ কয়েকটি ব্যাংকের প্রায় ১২ সাড়ে কোটি ডলারের ইডিএফ ঋণ লুটেছে। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ টাওয়ালের নামে ৪ কোটি ১৫ লাখ ডলার, আলফা কম্পোজিটে ৫ কোটি ৮১ লাখ ডলার, হিন্দোলয়ালী টেক্সটাইলে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ও শাহরীশ কম্পোজিটের নামে ৯৭ লাখ ডলার বের করে নেয়া হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।
পিছিয়ে নেই বেক্সিকো ও আকিজ: রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ইডিএফের ঋণ নিয়ে যথাসময়ে ফেরত দেয়নি বেক্সিমকো গ্রুপও। এ গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইডিএফ ঋণ আটকে রয়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। এই ঋণের বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেক্সটেক্স গার্মেন্টসের কাছে ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলসের কাছে ২ কোটি ৫২ লাখ ডলার, অ্যাসেস ফ্যাশনের কাছে ২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ও অ্যাপোলো অ্যাপারেলও লিমিটেডের কাছে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ বিষয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের জিএম আবু শফিউল্লাহ বলেন, করোনার সময় আমরা যেসব রপ্তানি করেছি, সেই আয়টা সময়মতো পাইনি। এ কারণে ঋণটা সমন্বয় হয়নি। তবে এখন আমরা ধীরে ধীরে এই ঋণটা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া আকিজ গ্রুপে সহযোগী প্রতিষ্ঠান আকিজ জুট মিলসের কাছে ইডিএফ ঋণ আটকে আছে প্রায় ২ কোটি ৮ লাখ ডলার।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আব্দুল জব্বার বলেন, আমি ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে আসার পর নতুন করে কোনো গ্রাহককে ইডিএফ ঋণ দেয়া হয়। আগের বকেয়া ইডিএফ ঋণের অধিকাংশই পরিশোধ করা হয়েছে। এখন সামান্য যা বাকি আছে সেটা বেক্সিকোর। এসবি পুণ্য গ্রুপের পকেটেও গেছে ইডিএফ: এসবি পুণ্য গ্রুপের শাহজাহান বাবলুও ইডিএফ ঋণের সুবিধাভোগী। তার প্রতিষ্ঠান এসবি এক্সিম বাংলাদেশের কাছে ইডিএফ ঋণের প্রায় ৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার আটকে আছে।
তালিকায় নামসর্বস্ব আরও অনেক প্রতিষ্ঠান: গোলাম ফারুক নামে এক ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন এসকিউ বিরিছিনা এবং মেসার্স এসকিউ সেলসিয়াস লিমিটেডের কাছে আটকা ৩ কোটি ৬২ লাখ ডলার, হংকংভিত্তিক মাস্ট গ্রুপের এদেশীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান লেনি ফ্যাশনস লিমিটেডের কাছে ৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার, নর্থপোল বিডির কাছে ১ কোটি ৮ লাখ ডলার, কাদেনা স্পোর্টওয়্যারের কাছে ১ কোটি ডলার, নর্ম আউটফিটের কাছে ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার ডলার, ভালটেক্স ইন্টারন্যাশনালের কাছে ২৮ লাখ ৩২ হাজার ডলার, মোডিস্টি (সিইপিজেড) লিমিটেডের ২৬ লাখ ২৪ হাজার ডলার, মেসার্স এস এন ফ্যাশনের ১৬ লাখ ২৪ হাজার ডলার, আনোয়ার ফ্যাশনের ১০ লাখ ৮৫ হাজার ডলার, শিলা অ্যাগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ১০ লাখ ৬৯ হাজার ডলার, মেসার্স রিপন ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ১০ লাখ ৬২ হাজার ডলার, এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যারের ৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার, এমএন নিটওয়্যারে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ডলার, পদ্মা ওয়্যারসের ৬ লাখ ১০ হাজার ডলার, মডিস্টি বাংলাদেশের কাছে ৫ লাখ ২৮ হাজার ডলার আটকে রয়েছে।