রফিক মজিদ, শেরপুর: গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কখনও মুছে যায় না, হয়তো আড়ালে থাকে। আড়াল থেকে আবার উঁকি দেয় এবং সে ইতিহাস ক্রমাগত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্মরণীয় হয়ে থাকে। যেমন ১৮ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত তখনকার শেরপুর পরগনায় (বর্তমান শেরপুর) জমিদারদের দাপট ছিল। তাদের শাসন বা ক্ষমতা নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা।
তবে এ অঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে তাদের কার্পণ্য ছিল না। ওই সময় নারী সাহিত্যের জাগরণও ঘটে। শেরপুরের জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর তৃতীয় ছেলে হেমাঙ্গ চৌধুরীর স্ত্রী ছিলেন হিরণ্ময়ী চৌধুরী।
শেরপুরের সাহিত্যাঙ্গন নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ করছেন শেরপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক ও আলোচক জ্যোতি পোদ্দার। তার অনুসন্ধানী লেখা ‘শেরপুর পরগনার কচড়া’ লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘অন্তঃপুরবাসিনী হয়েও তিনি (হিরণ্ময়ীচৌধুরী) স্থানীয় বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সামন্ততান্ত্রিকতার ভেতর নারীর ভূমিকা কেবলই সেবিকা আলাদা করে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সামন্ত জমিদার কুণ্ঠিত। কেননা একমাত্র তারামণি ছাড়া আর কোনো অন্তঃপুরবাসিনীর নামে কোনো স্থাপনায় নামাঙ্কিত করতে দেখা যায়নি, কিন্তু ব্যতিক্রম হিরণ্ময়ী চৌধুরীর ক্ষেত্রে।’
হিরণ্ময়ী আনিবাড়ি জমিদারের পুত্রবধূ ছিলেন। তার কাজের স্বীকৃতি বা স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে শুধু আনিবাড়ি নয়, আড়াই আনি জমিদারের নানা তৎপরতা চোখে পড়ে। এই তরফের জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী তার বাবার নাম অনুযায়ী গোবিন্দ্র কুমার পিস মেমোরিয়াল নামে যে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমানে জিকে পাইলট হাই স্কুল) সেই স্কুলে সে সময় পাঁচ হাজার বই নিয়ে হিরণ্ময়ী লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ওই লাইব্রেরিতে বই রয়েছে মাত্র এক হাজার ৪০০টি। ওই লাইব্রেরিতে এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তালপাতার পুঁথি সংরক্ষিত ছিল।
অন্যদিকে নালিতাবাড়ী উপজেলার আড়াই আনি বাজারে শেরপুরের আড়াই আনি জমিদারের হিস্যার অংশে গোপাল দাস চৌধুরী হিরণ্ময়ী মাইনর স্কুল (বর্তমানে হিরণয়ী উচ্চ বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন। তবে স্কুলের সাইনবোর্ডে হিরণ্ময়ীর নাম ছাড়া তার আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। শিক্ষার্থী তো দূরের কথা অনেক শিক্ষকই জানেন না, কে এই হিরণ্ময়ী।
জ্যোতি পোদ্দার লিখেছেন, কবি হিরণ্ময়ী এই উত্তর জনপদের প্রথম নারী, যার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থের ভূমিকাও লিখেছিলেন জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী। তবে দুঃখের বিষয় হলো সেই গ্রন্থটি বর্তমানে কোথাও সংগ্রহে নেই।
শেরপুর জিকে পাইলট হাই স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল হক বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর দেখলাম হিরণ্ময়ী লাইব্রেরি ধ্বংসের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে যাচ্ছে। আলমিরায় থাকা শত বছরের পুরোনো বইগুলো উইপোকা সাবার করে ফেলছিল। অনেক বই আমি বস্তাবন্দি অবস্থা থেকে তুলে এনে বাঁধাই ও গ্রন্থতালিকা করেছি। কাঠের আলমিরাগুলোকেও সংস্কার করা হয়েছে। স্কুলের শতবর্ষ উপলক্ষে লাইব্রেরির ভেতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। লাইব্রেরির ছাদ চুয়ে পানি পড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ছাদ। ফলে এখন শিক্ষার্থীদের জন্য উম্মুক্ত করে বই পড়ার সুযোগ হয়েছে।
নালিতাবাড়ী হিরণ্ময়ীউচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, বর্তমানে স্কুলে হিরণ্ময়ীর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। তবে ব্রিটিশ আমলে স্কুল পরির্দশন বইটি রয়ে ছে। এতে সে সময়কার বিভিন্ন লাটদের পরিদর্শনের স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়া জমিজমার কাগজপত্র রয়েছে।