তাসনিম হাসান আবির: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। বিজয়ের ৪৯টি বছর আমরা পার করে এসেছি। সামনের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে আমরা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। জাতির পিতার স্বপ্নে গড়া এই সোনার বাংলা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি বিজয় অর্জন করে। যে দেশটিকে কেউ কখনও গণ্যই করেনি, যে দেশকে নিয়ে সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল, সেই দেশটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিজেদের জয় ছিনিয়ে আনে। আজীবন বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জন্য কাজ করে গিয়েছিলেন। তাই বাঙালির স্বাধীনতার জন্য তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধের জয় ছিনিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বাঙালির ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। বীর বাঙালির গৌরবগাথা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজকের এই বাংলাদেশে রূপান্তর হওয়া এতটা সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে, অনেক বাধাবিপত্তি সামলে আমরা এই জায়গায় এসেছি। পরাজিত শক্তি অনেকবার এই বাংলায় আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি সেগুলোকে বারংবার হারিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে আছে। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে যে, বিজয়ের এই এতবছর পর এসে আসলে বাংলাদেশ কীভাবে চলছে বা বিজয়-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কতটুকু। অনেকেই অনেকভাবে এটার বিশ্লেষণ করবে। তবে সামগ্রিকভাবে এটা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যায়।
বিজয়ের ৪৯ বছরে এসে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে অভূতপূর্ব। বিশেষ করে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। চারপাশে শুধু কাজ আর কাজ। এর মধ্যে অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান আছেÑকর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতু যার উদাহরণ। আবার খুব শিগিগিরই ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের কাজও শুরু হবে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে চোখে পড়ার মতো, ব্রিজ, সেতু, ফ্লাইওভার হয়েছে অগণিত। বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিজয়-পরবর্তী উন্নয়নের সুফল সবাই কমবেশি ভোগ করছে।
বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেটা কয়েক বছর আগেও কেউ কল্পনাও করতে পারত না। সব ক্ষেত্রে এখন ডিজিটাল ছোঁয়া। সব কাজ এখন অনলাইনে করা যায়। এই করোনার সময় মানুষ আরও ভালোভাবে এটা উপলব্ধি করেছে। পড়াশোনা, চাকরি, অফিস, আদালত, সভা, সেমিনার, বাজার সবকিছুই আজকাল অনলাইনে চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফলভোগী আমরা সবাই। যে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্ব আগে হাসি-ঠাট্টা করা হতো, সেই দেশটি আজ ডিজিটাল বিশ্বে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বিজয়লাভের সময় বাংলার মানুষের শিক্ষালাভের হার ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু বিজয়ের ৪৯ বছরে এসে আমরা শিক্ষায় রেকর্ড সাফল্য অর্জন করেছি। এখন বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে শিক্ষিত সন্তান আছে। এসএসসি ও এইচএসসি’তে সাফল্যের হার সন্তোষজনক। শিক্ষার আলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রচুর শিক্ষার্থী এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে গিয়ে সাফল্য অর্জন করে দেশের সুনাম বয়ে আনছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। এই করোনা মহামারির সময়েও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। অনলাইনে নিয়মিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে।
বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুৎ, যেটা বিজয়ের প্রথম দিকে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৯ বছরে এসে এখন গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘শতভাগ বিদ্যুৎ পরিপূর্ণ বাংলাদেশ’ উদ্যাপনের অপেক্ষায় আমরা এবং সেটি অবশ্যই সম্ভব হবে। লোডশেডিং এখন ইতিহাস। মানুষ এখন ভুলেই গেছে লোডশেডিং আসলে কী? কারণ চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের জোগান চলছে এবং রামপালসহ আরও নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে এখন মানুষ টিভি দেখছে। ছেলেমেয়েরা বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা করে নিজেদের আলোকিত করছে।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির হারও বেড়েছে। মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির হারও বেড়েছে, যদিও এই করোনা বছরে প্রবৃদ্ধির হার সাময়িকভাবে কমেছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক সামাজিক মানবসূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। এদেশে বিনিয়োগ বেড়েছে। নতুন নতুন কল-কারখানা তৈরি হয়েছে। বিদেশি রেমিট্যান্স থেকে আয় বেড়েছে। পোশাক খাতসহ অনেক খাত থেকে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি সবসময় বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে এদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো যখন সন্ত্রাসী হামলায় কাঁপছে, তখন বাংলাদেশ অনেক শান্তিতে আছে। বাঙালি জাতি সবসময় শান্তিপ্রিয় জাতি। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলা এদেশে হয়েছে, যেটা এখন অনেক কমে গেছে। এদেশে বিচারব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। দেশের বিচার বিভাগ রাজাকারদের বিচার করে শাস্তি কার্যকর করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের আওতায় এনে রায় কার্যকর করা হয়েছে। এটা ছিল বিচার বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও কিছু ক্ষেত্রে এখনও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বিজয়ের এই এত বছরে এসে এখনও এদেশে উল্লেখযোগ্য হারে ধর্ষণ হচ্ছে। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটছে। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধা বা যুবতী কেউই রক্ষা পাচ্ছে না নরপিশাচদের হাত থেকে। নারীর স্বাধীনতা নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠেছে। রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেটা আমাদের কাম্য ছিল না। আজকে ঘরের ভেতর ঢুকে ধর্ষকরা নারীর ইজ্জতে আঘাত হানছে। অথচ ১৯৭১ সালের বিজয়ের জন্য নারীরা ছিল অগ্রগামী। তারা পাকিস্তানিদের কাছে নিজেদের সম্ভ্রম হারিয়েছে, কিন্তু এদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেনি। অথচ এখন স্বাধীন বাংলাদেশে এসে নারীকে অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে।
বিজয় লাভের ৪৯ বছরে এসে এদেশে দুর্নীতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যেটা আমাদের কাম্য ছিল না। একজন ড্রাইভার থেকে শুরু করে মালী, কর্মচারী, দারোয়ান, সুইপার এরা দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। বড় বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। বাংলাদেশের মানুষের কষ্টের টাকা দুর্নীতিবাজরা বিদেশে পাচার করছে, কালোটাকার পাহাড় গড়ছে, আর গরিবের পেটে লাথি দিয়ে নিজেরা সুখ খুঁজছে; কিন্তু এটা আমাদের কাম্য নয়। সামনের বছর আমরা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিতÑআমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশে এই গৌরবোজ্জ্বল দিনটি পালন করব। এটার জন্য নিজেদের মধ্যে দেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের লাগামছাড়া দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এদেশে জন্মগ্রহণ করে প্রত্যেকটি নাগরিক গর্বিত, কারণ আমরা বীরের জাতি। আমরা আমাদের নায্য অধিকার কীভাবে আদায় করতে হয়, সে বিষয়টা ভালোভাবেই জানি। বাঙালিকে কখনও দাবায়ে রাখা যায় না। ৪৯ বছরে এসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যেন আরও জোরদার করা হয়। কারণ এদেশে দিনকে দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত বেকার তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য বোঝাস্বরূপ। তাই এ বিষয়টার প্রতি আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিজয়ের ইতিহাস আমাদের গর্বের। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বিশ্বসেরা। সামনের বছর আমরা বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। বিজয় দিবসের থেকে শিক্ষা নিয়ে যেন আমরা দেশপ্রেমে আরও উদ্বুদ্ধ হতে পারি এবং সর্বদা দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারি, সেটাই হোক সবার কামনা। বিজয় দিবস আমাদের অহংকারের, আমাদের আত্মমর্যাদার, আমাদের অনুপ্রেরণার। বিজয়ের সুমহান মর্যাদা আমরা সবাই ধারণ করে যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারিÑসে প্রত্যাশাই হোক সব বীর বাঙালির।
শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
tasnimhasan408@gmail.com