সাইফ ইউ আলম: তানজিলা ও মিম রৌপ্যমুদ্রা নিয়ে তুমুল বাক্য বিনিময় করছে। তানজিলা বলছে এ মুদ্রা দুইশ বছর আগের। আর মিম বলছে তিনশ বছর আগের মুদ্রা এটি। এ নিয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে তারা নিচু স্বরে কথা কাটাকাটি করছিল। এ সময় এক অফিস সহকারী জানান রৌপ্য মুদ্রার আসল ইতিহাস। ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রচলন ছিল এ মুদ্রার।
এভাবে ছাত্রছাত্রীদের কৌতূহল মিটিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অজানা রহস্য জানা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর ঘুরে। এ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের লেখা চিঠিপত্র, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যুদ্ধনির্দেশনা, যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের হিসাবপত্র, স্বাধীনতার চিঠিপত্র, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবির মূল দলিল। আরও আছে হাতে লেখা প্রচীন কোরআন শরিফ। মধ্যযুগের ১৪টি যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে এ জাদুঘরে। দেখা যাবে পালকি, মেহরাবের খিলান, পাথর খোদাই করা নরবলির দৃশ্যাবলি। এ জাদুঘরে জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, মুর্তোজা বশির, আবদুল্লাহ খালিদ, রশিদ চৌধুরী, নিতুন কুণ্ডু প্রমুখ শিল্পীর বিখ্যাত অনেক শিল্পকর্ম রয়েছে।
প্রতœতত্ত্ব, ইতিহাস, প্রাচীন শিল্পকলার নির্দশন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও এসব বিষয়ে মৌলিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালের ১৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর তথা দেশের একমাত্র ‘একাডেমিক মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা হয়। এ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে সমুন্নত করেছে।
ফ্ল্যাশব্যাক
ইতিহাসের পঠন-পাঠনে জাদুঘর একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রতœতাত্ত্বিক উপাদানের সংরক্ষণাগার হিসেবে জাদুঘরের ব্যবহার সমাজে স্বীকৃত। জাদুঘরের এ ভূমিকার কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. আবদুল করিমের অনুপ্রেরণায় দেশের নানা স্থানের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার শুরু হয়। ছাত্র-শিক্ষকের প্রচেষ্টায় সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। প্রথম দিকে নিদর্শনগুলো বিভাগের একটি কক্ষে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস বিভাগের সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার দিনে চারটি কামান, কয়েকটি তরবারি ও কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে পথচলা জাদুঘরটি এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই ছোট্ট জাদুঘরটি এখন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখানে ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা, জাতিতত্ত্ব ও অলংকার শিল্পকলাসহ ইতিহাসের নানা নিদর্শন দেখতে আসেন শিক্ষার্থীরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের অধ্যাপক রিচার্ড ইটন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ রচনার জন্য এ জাদুঘরের পুরোনো পত্রিকা ও দুর্লভ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলরবিদ হেনরি গ্যাস্ট্র, মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন শিক্ষক, প্রখ্যাত ভৌতবিজ্ঞানী ড. জামান নজরুল ইসলাম, লেখক ও গবেষক শামসুজ্জামান খান, পশ্চিমবঙ্গের লেখক গৌতম ভদ্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুপতা সিনহাসহ আরও অনেক দেশি-বিদেশি লেখক-গবেষক এখানে তাদের গবেষণাকর্ম চালিয়েছেন।
কার্যক্রম
জাদুঘরটির নিচতলায় রয়েছে রেফারেন্স লাইব্রেরি ও প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণাগার। দ্বিতীয় তলায় প্রাচীন নিদর্শনগুলো রাখা হয়েছে। জাদুঘরকে প্রদর্শনী ও স্টাডিসÑএ দুই বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রদর্শনী বিভাগে পাঁচটি গ্যালারি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রাক-ঐতিহাসিক গ্যালারি, ভাস্কর্য গ্যালারি, ইসলামি নিদর্শন গ্যালারি, লোকশিল্প গ্যালারি ও স্থায়ী আর্ট গ্যালারি। স্টাডিস বিভাগে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রায় চার হাজার বই-সাময়িকী রয়েছে। পুরোনো ছাপা পুঁথি আছে প্রায় দুইশ। আছে ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, ধর্মবিষয়ক প্রায় তিন হাজারের মতো পুরোনো বই। তিন হাজার বছরের পুরোনো সাময়িকীও আছে এখানে। পূর্ব পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত প্রায় সব পত্রিকাই দেখতে পাবেন এখানে।
অবদান
যাদের চেষ্টায় এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে, তারা হলেনÑচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম, প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য এমআর মল্লিক, শামসুল হোসাইন ও মামুনুল বারী। একই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় প্রতœতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় জাদুঘর, চট্টগ্রাম বন্দর জাদুঘর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিতত্ত্ব বিভাগসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে।
সমস্যা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলেবর যেমন বেড়েছে, তেমনি দেখা দিয়েছে নানা সমস্যাও। বৃষ্টির পানিতে অনেক মূল্যবান সংগ্রহ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। উপ-কিউরেটর, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, অনুসন্ধানকারীর পদসহ প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব আছে। সংরক্ষিত সামগ্রীর ইনভেনটরি, ডকুমেন্টেশন, ক্যাটালগিং প্রভৃতি ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনা হয়নি। জনবলের অভাবে নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রদর্শনী গ্যালারি বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাইডরা অনেক সময় দর্শনার্থীদের জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর দিতে পারেন না।
প্রত্যাশা
সময়ের প্রয়োজনে আনুষঙ্গিক কাঠামোর সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়া নিয়মিত তথ্য ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা উচিত। দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা উচিত এ জাদুঘর।