ক্রীড়া প্রতিবেদক : পবিত্র ঈদুল আজহার আর মাত্র একদিন বাকি। তার আগেই শুরু হয়ে গেছে ঈদ উৎসব। মিরপুরে সিরিজের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এ জয়টিকে বাংলাদেশের ক্রিকেট-প্রেমীদের জন্য সাকিব-তামিমদের ঈদ উপহার। অস্ট্রেলিয়া দল গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে না আসতে নানা অজুহাত দেখাচ্ছিল। অবশেষে অজিরা এলো এবং প্রথম টেস্টেই হারল টাইগারদের কাছে। শেষবার দুই দলের দেখাটা হয়েছিল ১১ বছর আগে।
বাংলাদেশের মানুষের সময়টা বেশ খারাপ যাচ্ছিল। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ নাড়া দিচ্ছে সব বাংলাদেশি মানুষের হƒদয়ে। সাম্প্রতিক বন্যার ভয়াবহতা যেন এবারের ঈদের আমেজে বেশ প্রভাব ফেলেছে। এমন অবস্থায় সাকিব-তামিমদের কাছ থেকে এমন একটা জয়ের আশাই ছিল। বাংলার এ টাইগাররাও নিরাশ করেননি পুরো দেশের মানুষকে। এনে দিলেন আনন্দের উপলক্ষ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে ২০ রানের ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে মুশফিকবাহিনী।
তবে গতকাল সকালে যখন ডেভিড ওয়ার্নার ও স্টিভেন স্মিথ ব্যাটিং শুরু করছিলেন, মনে হচ্ছিল জয়টা বোধহয় হাতছাড়ায় হতে চলেছে হাথুরুসিংহের শিষ্যদের। বেশ সাবলীলভাবেই খেলছিলেন অজি অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক। অন্যদিকে মিরাজদের বোলিংয়ে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল। মিরপুরের দর্শকের হতাশ করে দিনের প্রথম ঘণ্টাতেই তুলে নিলেন ৬৫ রান এ দুই ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম অর্ধশতকের পর সেটিকে সেঞ্চুরিতে (১১২) রূপান্তরিত করলেন ওয়ার্নার।
কিন্তু বাংলার টাইগাররা বুঝতে পারল হাল ছেড়ে দিলে হবে না। লড়ে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। বোলিংয়ের ধার বাড়িয়ে দিলেন সাকিবরা। একের এক বিপজ্জনক বল ছুড়ে দিচ্ছিলেন অজিদের সামনে। আবারও বাংলোদেশে খেলায় ফেরাতে ত্রাণকর্তা হিসেবে
দায়িত্ব নেন সাকিব আল হাসান। সাকিব আল হাসানের ঘূর্ণি দুর্বোধ্য হয়ে উঠল অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের কাছে। প্রথমে সেঞ্চুরিয়ান ওয়ার্নারকে দলীয় ১৫৮ রানে এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলে সাজঘরে ফেরান বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার। এরপর ১৭১ রানে অধিনায়ক স্মিথকে মুশফিকের ক্যাচে পরিণত করেন। সাকিবের অগ্নিমূর্তি দেখে জ্বলে উঠলেন তাইজুল ইসলামও। পিটার
হ্যান্ডসকম্বকে সিøপে সৌম্যর ক্যাচে পরিণত করলেন তিনি। ম্যাথু ওয়েডকে এলবিডাব্লিউ করলেন সাকিব। অ্যাশটন অ্যাগারকে নিজের বলে নিজেই ক্যাচ নেন তাইজুল। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ যখন লাঞ্চে যায়, তখনই জয়ের একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন।
তবে টাইগারদের জয় নিশ্চিতে একমাত্র গলার কাঁটা হয়েছিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। লাঞ্চ থেকে ফিরেই প্রথম বলেই সে কাঁটাকেও উপড়ে ফেললেন সাকিব। ম্যাক্সওয়েলকে বোল্ড করেছেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার আট উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের সমর্থকরা তখন জয়োৎসবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেয়। তবে তাদের উৎসবে মেতে ওঠার সময়টাকে দীর্ঘায়িত করছিল দুই অজি টেলএন্ডার প্যাট কামিন্স ও নাথান লায়ন। তারা যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল কোনোভাবেই বাংলাদেশকে জয় পেতে দেবে না। ২৯ রানের জুটি গড়লেন তারা। লায়নকে সাকিব ফিরিয়ে দিলেও দেশের সমর্থকদের বুকের ভেতরের ধুঁকপুকুনিটা বাড়িয়ে তুলছিলেন কামিন্স। মিরাজকে এক ওভারে দুটি ছয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে প্রায় পৌঁছে দিচ্ছিলেন দলকে। গ্যালারিতে তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। জয়টা বোধহয় ফসকেই গেল বাংলাদেশের হাত গলে। অনেকের মনে তখন হয়তো ভেসে উঠছিল, ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুলতান টেস্টের স্মৃতি। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার
বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলা ফতুল্লার টেস্টের স্মৃতিও জেগে উঠছিল। যেখানে তখনকার অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং একাই ম্যাচটি জিতিয়েছিলেন।
কিন্তু না, ওই দুটি পুনরাবৃত্তি হতে দিল না বাংলাদেশের বোলাররা। মিরাজের বলে সুইপ করতে গিয়ে সৌম্যর দুর্দান্ত এক ক্যাচে পরিণত হন লায়ন। সিøপ থেকে বাম দিকে দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নেওয়া সৌম্যর ক্যাচটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লায়ন আউটের পর মাঠে নামেন চোটগ্রস্ত জশ হ্যাজেলউড। তবে হ্যাজেলউডকে আড়াল করেই খেলার চেষ্টা করছিলেন কামিন্স। স্ট্রাইকটা নিজের কাছে রাখছিলেন এ অজি বোলার। বাংলাদেশের বোলাররা সুযোগই পাচ্ছিলেন না শেষ ব্যাটসম্যানকে বোলিং করার। সুযোগ পেলেন তাইজুল। আর তাতেই ইতিহাস গড়ে ফেলে বাংলাদেশ। তাইজুলের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়লেন হ্যাজেলউড। শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ডের পর রচিত হলো অজিবধের ইতিহাস।
এ ম্যাচটি ঐতিহাসিক ছিল অনেক কারণে। ১১ বছর পর ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। এছাড়া এ ম্যাচটি ছিল সাকিব-তামিম ‘দুই বন্ধু’র ৫০তম ম্যাচ। এ ম্যাচে দুজনই দলের জন্য দিয়েছেন নিজেদের সেরাটা। আর বিধাতাও যে তাদের নিরাশ করলেন না। দুজনকেই দিয়েছেন দুই হাতজুড়ে। আর এতে বাংলাদেশ পেল উৎসবের উপলক্ষ।
সাকিব-তামিম দুজনেরই ভূমিকা ছিল এ ম্যাচে। তবে সাকিবের কথাটা বলতে হয় আলাদা করে। ম্যাচ জয়ের নায়ক যে তিনিই। প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও তুলে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো এক টেস্টে ১০ উইকেট তুলে
নিলেন। কিন্তু এ জয় ব্যক্তিগত সেই অর্জন ছাপিয়ে দুর্দান্ত এক দলগত অর্জন বাংলাদেশের।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ
প্রথম ইনিংস: ৭৮.৫ ওভারে ২৬০
দ্বিতীয় ইনিংস: ৭৯.৩ ওভারে ২২১ (তামিম ৭৮, সৌম্য ১৫, তাইজুল ৪, ইমরুল ২, মুশফিক ৪১, সাকিব ৫, সাব্বির ২২, নাসির ০, মিরাজ ২৬, শফিউল ৯, মোস্তাফিজ ০; হেজেলউড ০/৩, কামিন্স ১/৩৮, লায়ন ৬/৮২, ম্যাক্সওয়েল ০/২৪, অ্যাগার ২/৫৫, খাওয়াজা ০/১)
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস: ৭৪.৫ ওভারে ২১৭
দ্বিতীয় ইনিংস: ৭০.৫ ওভারে ২৪৪ (ওয়ার্নার ১১২, স্মিথ ৩৭, হ্যান্ডসকম্ব ১৫, ম্যাক্সওয়েল ১৪; সাকিব ৮৫/৫, তাইজুল ৬০/৩ ও মিরাজ ২/৮০)
বাংলাদেশ ২০ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা: সাকিব আল হাসান
Add Comment