শেখ আবু তালেব: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখসারিতে যুদ্ধ করেছে মুক্তিবাহিনী। এ যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন দেশের সর্বস্তরের জনগণ। যুদ্ধের সফল সমাপ্তি টানতে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে গঠন করা হয় মিত্রবাহিনী। আর দেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, চিকিৎসক, কৃষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে নিরলস কাজ করেছেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।
তিনি মার্কিন সরকারের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায় করেছেন। বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু শ্রীমতি গান্ধীর অবদানের দৃশ্যমান স্মৃতি ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশের কোনো সরকার।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধাত্রী বলা হয়। ইন্দিরা গান্ধীকে দেখতে হবে বড় পরিসরে। তিনি বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়ালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। তাই তার এ অবদানের স্মৃতিচারণে দেশে তার নামে হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয়, বড় হাসপাতাল বা কোনো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র, যার কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি গত ৫০ বছরে।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯১৭ সালে ভারতের বিখ্যাত নেহরু পরিবারে জš§গ্রহণ করেন। বাবা বিখ্যাত পণ্ডিত ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর মা কমলা দেবী। পারিবারিকভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইন্দিরা। ১৯৪২ সালের পরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠেন ভারতের রাজনীতিতে। ১৯৬৪ সালে তিনি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী এখন পর্যন্ত ভারতে প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন দলিল ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে একমাত্র বিদেশি বন্ধু ছিলেন তিনি। তার উদ্যোগ, উদারতা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দর্শনের কারণেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশিদের পক্ষে সমর্থন আসে। বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় ভারত। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ভারতের লোকসভায় দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা দেন, যা দেশটির রাষ্ট্রীয় বেতার অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সরাসরি প্রচার করা হয়।
ওইদিন ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ তাদের অধিকারের জন্য সংগ্রামে নেমেছে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহ করেছে। হাজার হাজার তরুণ ও কৃষক তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বিশ্ব নেতারা দেখছেন, এটি দেশের জনগণের দৃঢ় ইচ্ছার প্রতিফলন। তারা বিরাট এক বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে এই হাউসকে অবহিত করতে চাই, ভারতীয় সরকার সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
এই সময়ে তিনি সংসদে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, একাধিকবার উচ্চারণ করেন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। তিনি আরও বলেন, ‘এখন থেকে আমরা বাংলাদেশের সরকারের (তখনও অস্থায়ী সরকার) সকল ধরনের যোগাযোগ রাখব। পররাষ্ট্রসহ সকল ধরনের সরকারি যোগাযোগ সরাসরি করা হবে। বাংলাদেশ সরকারের সকল প্রতিনিধিকে সম্মান দিবে।’ আমি আরও জানাতে চাই, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির জনক হবেন।’
আজ সেই ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। বিশেষ এ দিনটি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছর থেকেই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ও দিল্লি। বিশ্বের ১৮টি দেশে জাঁকজমকভাবে আজ পালিত হচ্ছে দিনটি। বেলজিয়াম, কানাডা, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ১১৯ মার্কিন ডলার। ৫৪ কোটি মানুষের দেশ ভারত তখন চরম দারিদ্র্যপীড়িত। এর মধ্যেও এক কোটি শরণার্থীকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেবল সমর্থনই দেননি, সারাবিশ্বে তিনি এর সমর্থনে নিরলস কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাজ্য সফররত অবস্থায় বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেন ইন্দিরা গান্ধী। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভূয়সী প্রসংসা করেন। সে সময় বিবিসির সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন‘ভারত যদি বাংলাদেশের গেরিলাদের সব রকম সাহায্য বন্ধ করে দেয়, তাহলে সেখানকার সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ হয়ে যাবে কী না।’
এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই না। বাংলাদেশের জনগণ কারও মুখাপেক্ষী হয়ে ২৫ মার্চ রাতে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়নি।’ তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর সংখ্যক বাঙালি বাস করছে, তারা ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সব রকম সাহায্য নিয়ে তারা এগিয়ে এসেছে। এছাড়া বাংলাদেশের হাজার হাজার সেনা, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্য রয়েছেন; যারা যুদ্ধ করতে পারদর্শী এবং তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।’
স্বাধীনতার জন্য বাঙালির জাতীয়তাবোধ তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের প্রতি তার মনে অসীম শ্রদ্ধা জাগ্রত করেছিল। আর তিনি এটাও জানতেন যে, বাঙালির এই জাগরণ সম্ভব হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য। তাই বঙ্গবন্ধুকে যাতে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে না পারে, সে জন্য তিনি প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন।
ওই সময় বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন ঘুরে এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন একে গৃহযুদ্ধ অভিহিত করে পাকিস্তানের পক্ষে সমাধানের প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করে দেন। এরপর ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববাংলায় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের মূল্য দেয়া হয়নি। সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ পায়নি।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। শেখ মুজিব সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন ভাষণে বলেন, ‘শেখ মুজিব একজন অসাধারণ নেতা। তার সঙ্গে কারও কোনো তুলনা চলে না। যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ব্যবধানে তিনি জয়লাভ করেছেন, তা এক অসামান্য ঘটনা। তিনি চিন্তা-চেতনায় একজন আধুনিক মানুষ। পাকিস্তান সরকার তার সেই সাফল্যকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করছে।’
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদেশি বন্ধুদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে সম্মাননা জানায়। মুক্তিযুদ্ধের ৪০তম বছরে ভারতীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও বেশকিছু বিদেশি বন্ধুদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। ইন্দিরা গান্ধীকে ভূষিত করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা পদকে (মরণোত্তর)। ওই বছরের ২৫ জুলাই ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুলে দেয়া হয় এ পুরস্কার। এটি ছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশির অর্জন করা সর্বোচ্চ সম্মাননা।
যদিও শুধু ওই সম্মাননাতেই সীমিত হয়ে আছে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বাংলাদেশের মূল্যায়ন, যা যথাযথ নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তখন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত কোনো রাষ্ট্রই অপর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়েই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এটি চরমভাবে মানা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো কেউ ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি এই চারটি দেশ সফর করেন। ইউরোপের দেশগুলোর সমর্থন আনতে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সবাই বলেছিল, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু তখন ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে বুঝাতে পেরেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়েছে অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে। এখন আর এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নেই। এটি পরোক্ষভাবে ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধ। এটি ভারতের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ কথা বুঝানোর পরই আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়। এই কথা বুঝানোর জন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পায়। এটিই বাংলাদেশের জন্ম দেয়। এটি না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের ইতিহাস ভিন্ন হতো।’
স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর মূল্যায়ন এখনও বাংলাদেশ করেনি বলে মনে করেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীকে দেখতে হবে আরও বড় পরিসরে বলেও মন্তব্য করেন এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও তাজউদ্দীন আহমদের সহচর ছিলেন ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম। ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিচারণকালে অনেকটা আবেগকাতর হয়ে তিনি বলেন, ‘বাঙালি আত্মভোলা ও ইতিহাস ভোলা জাতি। আমরা ইতিহাসকে মনে রাখতে চাই না। জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক সংগঠককেই বাংলাদেশ সেভাবে মূল্যায়ন করছে না। তরুণ প্রজন্মকে জানাচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা জাতীয় ব্যক্তিদের।’
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশ তার এ অবদানকে অস্বীকার করতে পারে না। তার অবদানকে এখনও মূল্যায়ন করেনি সেভাবে। তবে করার সুযোগ এখনও রয়েছে। তার নামে কোনো বড় অবকাঠামো হতো পারে।