ইন্স্যুরেন্সের হাজারে ফাঁকি ১ টাকা!

রোহান রাজিব: নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) আইন লংঘন করে নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রিমিয়াম কম দিয়ে ‘গুড অ্যান্ড ফাস্ট প্যাকেজিং’ প্রতিষ্ঠানকে বিমার সুবিধা দিয়েছে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। ফলে প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ টাকা ক্ষতির পাশাপাশি সরকারের ভ্যাট ফাঁকি ও আইডিআরএ’র প্রতি এক হাজার টাকায় ১ টাকা ক্ষতি হয়েছে। গ্রিন ডেল্টার ওপর আইডিআরএ’র চালানো বিশেষ তদন্ত কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এছাড়া বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) পর্যাপ্ত তথ্য না দেয়া, ভ্যাট ফাঁকি, বাকিতে ব্যবসা, নির্ধারিত হারের চেয়ে এজেন্টকে বেশি কমিশন দেয়ার মতো বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে।

তদন্ত প্রতিবেদনে গ্রিন ডেল্টার বিরুদ্ধে বিমা আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও শুধু সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছে আইডিআরএ।

সূত্রে জানা যায়, বাড্ডার শাখা ব্যবস্থাপক তাইয়েব মহসিন নিজ কোম্পানি গ্রিন ডেল্টার বিরুদ্ধে বাকিতে ব্যবসা এবং কমিশন প্রদানে অনিয়ম ও তার বেতন-ভাতাদি বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ দেয় আইডিআরএ’কে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইডিআরএ গ্রিন ডেল্টায় তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করে। বিমার নিয়ন্ত্রক সংস্থার গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে গ্রিন ডেল্টার অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

আইডিআরএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্তের সাপেক্ষে গ্রিন ডেল্টার কাছে তথ্য চায় আইডিআরএ। তবে গ্রিন ডেল্টার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের স্বার্থে তথ্য চাওয়া হলেও আইডিআরএকে কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে আইডিআরএ গ্রিন ডেল্টার কাছে ব্যাংক ডিপোজিটের তথ্য, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও ব্যাংক ডিপোজিটের সিøপ চেয়েছিল। দুই-একটি তথ্য দেয়া হলেও বেশিরভাগ তথ্য প্রদান করেনি গ্রিন ডেল্টা। ফলে আইডিআরএর তদন্তে ব্যাঘাত ঘটে। তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশে বিশেষ কমিটি উল্লেখ করে, তথ্য না দেয়ার কারণে সঠিকমতো আইডিআরএর প্রতিনিধি দল সঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। ফলে তথ্য না দেয়ার কারণে গ্রিন ডেল্টার বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়। কারণ বিমা আইন ৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইডিআরএ তদন্তের সাপেক্ষে তথ্য চাইলে কোম্পানিগুলো দিতে বাধ্য থাকবে। যদি তথ্য প্রদান না করে তাইলে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করতে হবে’। তথ্য না দেয়ার জন্য তদন্ত প্রতিবেদনে শাস্তি দেয়ার কথা বললেও গ্রিন ডেল্টার বিষয়ে কোনো রকমের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

আবার গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে ‘গুড অ্যান্ড ফাস্ট প্যাকেজিং’- প্রতিষ্ঠানকে আমদানি-রপ্তানির মেরিন কার্গোর বিমা পলিসি করেছিল। গুড অ্যান্ড ফাস্টকে নির্ধারিত হারের চেয়ে কম প্রিমিয়াম নিয়ে বিমার সুবিধা দিয়েছে গ্রিন ডেল্টা। আইডিআরএর বিশেষ তদন্ত কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এরকম সুবিধা দিয়ে বিমা আইনের সুস্পষ্ট লংঘন করেছে কোম্পানিটি। এছাড়া গ্রিন ডেল্টার লাখ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রিমিয়াম কম নেয়ার বিপরীতে সরকারকে ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আর আইডিআরএর ক্ষতি হয়েছে প্রতি ১ হাজার টাকায় ১ টাকা। কারণ বিমা কোম্পানিগুলো আয়ের প্রতি হাজারে ১ টাকা করে দেয় আইডিআরএকে।

আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যদের নির্ধারিত প্রিমিয়াম রেট ০.১৪ পয়সা। আর বিজিএমইএ ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম নেয়ার নিয়ম ০.৩০ পয়সা। কিন্তু এখানে গ্রিন ডেল্টা গুড অ্যান্ড ফাস্ট প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রিমিয়াম রেট নিয়েছে ০.১৪ পয়সা করে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি বিজিএমই’র সদস্য নয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সদস্য। ফলে গ্রিন ডেল্টা ১৬ পয়সা কমে বিমা করার সুযোগ দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান জয়নুল বারীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

আইডিআরএ’র তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে ‘অধিক কমিশন প্রদান ও বাকিতে ব্যবসা করে বিমা আইন লংঘন করেছে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড’। বিমা আইন অনুযায়ী, নন-লাইফ বিমাকারীর লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্টের জন্য কমিশন হবে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, গ্রিন ডেল্টা এজেন্টের জন্য কমিশন হারের সীমা অনধিক প্রদান করে আইন লংঘন করেছে, যার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়ে, গ্রিন ডেল্টা বিমা আইন না মেনে এক গ্রাহককে ১৯.২৫ শতাংশ কমিশন প্রদান করেছে। যদিও তদন্ত প্রতিবেদনে গ্রিন ডেল্টার বিরুদ্ধে বিমা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করলেও সতর্ক করে কোম্পানিটিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বিমা আইন ২০১০’-এর ধারার ৪৯ (৪) মোতাবেক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাকিতে ব্যবসা করার কারণে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সকে বিমা আইন ২০১০-এর ১৩০ ধারা অনুযায়ী কোম্পানিকে ১৩৪ ধারা অনুযায়ী জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ লাইফ বিমাকারীর লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্টের জন্য কমিশন হারের অনধিক ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণে লংঘনের জন্য একই ধারায় ৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে বক্তব্যের জন্য হোয়াটঅ্যাপে মেসেজ করা হলেও কোনো উত্তর দেননি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০