ইপিজেড নমনীয়, হয়রানি করা হচ্ছে বিনিয়োগকারীকে

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার প্রতিনিয়ত উদ্যোগ নিচ্ছে। দিয়ে আসছে নানা ধরনের সুবিধা আর ছাড়। কিন্তু দুই সংস্থার দুই নীতির কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক সংস্থা বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করছে। অন্য সংস্থা বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করতে ব্যস্ত। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) বিনিয়োগকারীরা এমন অভিযোগ করেছেন। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) মাধ্যমে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। বিশেষ করে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানকে আমদানি-রপ্তানি নীতির আওতার বাইরে রাখা। কর সুবিধা দেয়া। ইউটিলাইজেশন পারমিশন (ইউপি) ও ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) ছাড়া রপ্তানির সুবিধা। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে বেপজার সব উল্টো পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানকে ইউপি, ইউডি দাখিলের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে রংপুর ভ্যাট কমিশনারেট। উত্তরা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ধরনের নির্দেশনার ফলে রপ্তানি কার্যক্রম গত দুই মাস ধরে স্থবির হয়ে আছে। এতে বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। হয়রানির ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ করে আমদানিতে চলে যাচ্ছে; যাতে দেশ থেকে ডলার চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া একই প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার অডিট করা হচ্ছে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হয়রানি বন্ধ করে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে বেপজা থেকে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ১৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন বেপজা থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। যাতে ‘ইপিজেডের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানিসহ সকল কার্যক্রম লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮-এর আওতামুক্ত রাখার’ অনুরোধ করা হয়। একইসঙ্গে ‘কাস্টমসের জারি করা স্থায়ী আদেশসমূহ বাতিল ও প্রস্তাবিত কাস্টমস (ইপিজেড) বিধিমালা, ২০২১ চ‚ড়ান্ত’ করতে অনুরোধ করা হয়। বেপজার সদস্য (বিনিয়োগ উন্নয়ন) ও অতিরিক্ত সচিব আলী রেজা মজিদ সই করা চিঠিতে বলা হয়, ইপিজেডে আমদানি-রপ্তানিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এনবিআর ১৯৮৪ সালে ‘দি কাস্টমস রুলস, ১৯৮৪’ জারি করে; যা এখনও বলবৎ রয়েছে। এনবিআরের ১৯৮৩ সালের এক আদেশ অনুযায়ী, ইপিজেডের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুক‚লে বন্ড রেজিস্ট্রেশন ও পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ২০০৮ সালে বেপজা ও ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এনবিআর ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সি বিধিমালা, ২০০৮’-এর বিধি-৪-এর মাধ্যমে ইপিজেডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে বন্ড লাইসেন্স গ্রহণ, নবায়ন, প্রাপ্যতা, সহগ নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে অসঙ্গতি ও জটিলতা দেখা দেয়। আবার ২০১৪ সালে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে স্থায়ী আদেশ জারি করলে জটিলতা আরও বাড়তে থাকে। এই নিয়ে এনবিআরকে বেপজা একাধিকবার চিঠি দিলেও সমস্যার সমাধান করেনি এনবিআর। যার ফলে ইপিজেডে বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানকে কাস্টমস ও ভ্যাট কমিশনারেট হয়রানি করছেÑউল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, ‘ইপিজেডসমূহকে জাতীয় আমদানি-রপ্তানি নীতি আদেশের আওতামুক্ত রাখা হয়। এরপরও সম্প্রতি রংপুর ভ্যাট কমিশনারেট ইপিজেডের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রপ্তানির ক্ষেত্রে ইউপি, ইউডি দাখিলের নির্দেশনা প্রদান করে। যার ফলে উত্তরা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম গত দুই মাস যাবত স্থবির হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে ইপিজেডের বিনিয়োগকারীরা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন, যা ইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগের চলমান প্রবাহের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠিতে চারটি অনুরোধ জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮ এর আওতামুক্ত রাখা, স্থায়ী আদেশসমূহ বাতিল করা; ইপিজেড প্রতিষ্ঠানের ইউপি, ইউডির প্রয়োজন হবে না মর্মে সকল কাস্টম হাউস, বন্ড কমিশনারেটকে নির্দেশনা প্রদান করা; কাস্টমস রুলস, ১৯৮৪ এবং সময় সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কাস্টমস আগের মতো সহজ নিয়মে ইপিজেড প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করতে কাস্টম হাউস ও বন্ড কমিশনারেটকে নির্দেশনা প্রদান করা; প্রস্তাবিত কাস্টমস (ইপিজেড) বিধিমালা, ২০২১ চ‚ড়ান্ত করতে বেপজা হতে পাঠানো খসড়া নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে সভার আয়োজন করা।

বেপজার চিঠির বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, এনবিআর সবার আগে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেয়। চিঠিতে যেসব অভিযোগ করা হয়েছেÑতা এনবিআর যাচাই করে দেখবে। আর যেসব সুপারিশ করা হয়েছে; তা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অন্যদিকে, ভুক্তভোগী একাধিক ব্যবসায়ী রপ্তানি ধ্বংস হওয়ার জন্য এনবিআরের ভুল নীতিকে দায়ী করেছেন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, স্থানীয় বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের কারণে-অকারণে হয়রানি করে কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তারা। বিশেষ করে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা হচ্ছে। ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে পণ্য আরেক প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর আগেই কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হাজির হচ্ছেন। কারণে-অকারণে মামলা দিচ্ছেন। আবার কখনও বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা গাড়ি ধরছেন, বন্ড সুবিধার কাঁচামাল অজুহাত দেখিয়ে লক করছেন। এতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ভয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল বা পণ্য কিনছে না। প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে কাঁচামাল আমদানিতে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইপিজেড ও ইপিজেডের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হয়রানির কারণে উৎপাদন বন্ধ করে আমদানিতে চলে গেছে। এতে একদিকে দেশীয় বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো লোকসানে পড়ছে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আমদানির ফলে দেশ থেকে ডলার চলে যাচ্ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে হলে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বেপজার দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেছেন, কাস্টমস সদস্য (শুল্ক: রপ্তানি, বন্ড ও আইটি) সদস্যের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো হয়রানির শিকার হচ্ছে। তিনি ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান থেকে ইউপি ও ইউডি নেয়া, একাধিকবার অডিট করার নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। এতে কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তারা ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানে কখনও হানা দিচ্ছে, কখনও গাড়ি আটকাচ্ছেন, কখনও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাগজপত্র ও পণ্য তল্লাশি করছেন। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সদস্যের নির্দেশনায় কাস্টমস ও ভ্যাট কর্মকর্তারা বন্ডেড ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানির ওপর রাখছেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) এর আওতাধীন প্রায় ৩০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে সম্প্রতি হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে। যার ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছেÑপোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান অবন্তী, অহনা নিট কম্পোজিট, টোটাল ফ্যাশন, নিউরোসেল প্রভৃতি। এসব প্রতিষ্ঠান পোশাক রপ্তানির ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। বন্ডের বেশিরভাগ সচল প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। কাস্টমসের ওই সদস্য বন্ড কমিশনারেটের  ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে ও প্রভাব খাটিয়ে এসব মামলা করাচ্ছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০