আতিক এম রহমান, ইবি: কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রায় ১৮ মাস পর ক্যাম্পাস খোলার প্রস্তুতি হিসেবে ‘করোনা স্পেশাল ফান্ড’ গঠন করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সেই ফান্ডে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। একাডেমিক ও আবাসিক খাতে সেই টাকা বরাদ্দের জন্য ১৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন উপাচার্য। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ও প্রসাশন ভবন সংস্কারে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বাকি অর্থ বিভাগগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এতে পুরোনো বিভাগগুলো দুই লাখ ও নতুনগুলো এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ পায়।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অফিসের তত্ত্বাবধানে মোট আটটি আবাসিক হল ও প্রশাসন ভবনের সংস্কারকাজে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দের তিন মাসেরও বেশি সময় পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথক আট ঠিকাদারকে এ কাজ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। টেন্ডারের শিডিউল অনুযায়ী সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল এবং স্যানিটারি-প্লাম্বিং ক্যাটেগরিতে কাজ চলছে, যা সমাপ্ত করতে হবে ১২ নভেম্বরের মধ্যে।
এদিকে হলগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে কাজের মান নিয়ে উঠেছে নানা অভিযোগ। আবাসিক শিক্ষার্থী, ছাত্রসংগঠনের নেতারা এবং খোদ প্রভোস্টদের কেউ কেউ এ অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ অনুসারে, হলগুলোয় ইলেকট্রিক ও প্লাম্বিংয়ের সংস্কারে কম দামি সুইচ, বাল্ব, টিউবলাইট, শাওয়ার ও ট্যাপকল ব্যবহার করছেন ঠিকাদাররা। এছাড়া ওয়াশরুমে বড় বেসিনের জায়গায় ছোট বেসিন বসানো ও নতুন দরজা সঠিকভাবে সেটিং না করায় বিপত্তির কথা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সিভিল সেকশনের মেরামত, প্লাস্টার ও রঙের কাজেও উঠেছে নানা প্রশ্ন। শিডিউলে উল্লিখিত রঙের পরিবর্তে কম দামি রং, সিলারের পরিবর্তে চুন ব্যবহার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্লাস্টারের কাজে জোড়াতালি, কাঁচা দেয়াল শুকানোর আগে ও শ্যাওলাযুক্ত দেয়াল ভালোভাবে না ঘষে যেনতেনভাবে রং করার অভিযোগ উঠেছে। দেড় কোটি টাকার বরাদ্দে এমন দায়সারা কাজের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কার কথা বলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে সাইট ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও হল প্রশাসনের দায়িত্ব অবহেলারও অভিযোগ করেছেন তারা। সরেজমিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, সংস্কার বাবদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে সবচেয়ে বেশি ২৭ লাখ সাড়ে ২৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাদ্দাম হোসেন হলে ২৩ লাখ ৭৭ হাজার, লালন শাহ হলে ২০ লাখ ৬৮ হাজার, জিয়াউর রহমান হলে ১৯ লাখ ২৫ হাজার, খালেদা জিয়া হলে ১৫ লাখ ৯৬ হাজার, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ১৩ লাখ ১২ হাজার, শেখ হাসিনা হলে ৬ লাখ ২৭ হাজার, শেখ রাসেল হলে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসন ভবনের সংস্কারকাজে বরাদ্দ হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী পলাশ হোসেন বলেন, এখানকার কাজের যা মান, তা আমার বাড়িতে হলে আমি মেনে নিতাম না। কম দামি পণ্য ব্যবহার তো আছেই, তার ওপর রং-প্লাস্টারের কাজেও গোজামিল। কাজের সঠিকভাবে তদারকিও হচ্ছে না।
শেখ হাসিনা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নওরীন নুসরাত বলেন, হলের ট্যাপকল, বেসিনসহ ওয়াশরুমগুলোয় নানা সমস্যা রয়েছে। বারবার অভিযোগ করেও এখনও সমাধান হয়নি। যে সংস্কারকাজ হচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
ইবি রিডিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাদিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীরা যখন ক্যাম্পাস খোলার আন্দোলন করছিল তখন প্রশাসন বারবার বলেছে, তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা দেখছি তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাই তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করে; শেষও করতে চাইছে যেনতেনভাবে। দেড় কোটি টাকার কাজে পুকুরচুরি চলছে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী
ব্যবহার হচ্ছে আমাদের দাবি, তড়িঘড়ি না করে প্ল্যানমাফিক ও মানসম্মত কাজ নিশ্চিত করুন। যথাযথ মনিটর করুন। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সবকিছুর জন্যই আন্দোলন করতে হয়। অথচ আমরা এসেছি পড়ালেখা করতে।
প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. রেবা মণ্ডল বলেন, আমরা ইঞ্জিনিয়ার অফিসের মাধ্যমে হলের কাজগুলো বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছি। কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করলে সেটি সঙ্গে সঙ্গে সারিয়ে নিচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মুন্সী শহীদ উদ্দীন মো. তারেক বলেন, আমি নিজে আমার টিম নিয়ে সাইট ভিজিট করেছি। সত্যি বলতে, কিছু কাজে আমি নিজেও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের কড়া নির্দেশনা দিয়েছি। যে কোনো উপায়ে কাজের মান ভালো করতে চেষ্টা করছি।
উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম বলেন, ঠিকাদাররা চায় বেশি লাভ করতে। তারা ২০ টাকার কাজ করে ৮০ টাকা লাভ করতে চায়। কিন্তু ৮০ টাকার কাজ বুঝে নেয়া প্রধানত প্রভোস্টদের কাজ। আর দ্বিতীয়ত আমার শিক্ষার্থীদের। আমি ঢাকায় আছি। প্রো-ভিসি ট্রেজারার মহোদয়কে বলে দিচ্ছি, চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে যেখানে বেশি সমস্যা হচ্ছে, প্রয়োজনে সেখানে কাজ বন্ধ করে দেয়া হবে।