Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 4:04 pm

ইভিএমে ভোট গ্রহণে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে কি?

মোহাম্মদ আবু নোমান : দেশবাসী কি আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচনের দিকে যেতে চায়? এখনও দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা যেভাবে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি দিচ্ছেন, তাতে বলতেই হয় এগুলো কোনো মুক্তির পথ নয়, সম্প্রীতির পথ নয়। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের চরিত্রের ও মানসিকতার উন্নতি হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশে সংঘাত নয়, আমরা ঐক্যের বাংলাদেশ চাই। নির্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। ইসি ও সরকার একে অপরের পরিপূরক নয়। ইসি ও তার কমিশনাররা সরকারের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কৌশলী হবে না। ইসিদের কর্ম, বক্তব্য ও বিবৃতিতে এটা যেন প্রতীয়মান না হয়, তারা ক্ষমতাসীনদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর দু-একটি বাদে বেশিরভাগই বিতর্কিত হয়েছে; তখন যারা ক্ষমতায় ছিল নির্বাচন কমিশন যেন ক্ষমতাসীনদের নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করা একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছিল।

রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন অর্ধেক, তথা ১৫০টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন যে ধারাবাহিক সংলাপ করেছিল, তাতে বেশিরভাগ দলই ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিক যৌথ বিবৃতিতে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইভিএম নিয়ে এর আগে ১৯ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফার মতবিনিময় সভায় ইভিএমে একজনের বাটন আরেকজন টিপে দেয়া, ইভিএমে ধীরগতি এবং কম ভোট পড়ে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে জানানো হয়েছিল।

ইভিএম ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যখন প্রবল মতভেদ, তখন নির্বাচন কমিশন প্রায় দুই লাখ ইভিএম কেনার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এর জন্য খরচ হতে পারে কমবেশি আট হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন আমাদের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে দুই লাখ ইভিএম কেনার উদ্যোগ নিয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইভিএম ব্যবহারের উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন, না কেনাকাটার প্রশ্নটিই মুখ্য? বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন বড় ধরনের চাপের মুখে, তখন বিপুল অর্থ খরচ করে ইভিএম কেনা কেন? যেহেতু কমিশনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৫০ আসনে ব্যালটে ভোট হবে, বাকি আসনেও সেটি করলে বিতর্ক এড়ানো যাবে। একই সঙ্গে অর্থও বাঁচবে।

ইসির হাতে এখন দেড় লাখ ইভিএম আছে। এক দিনে ১৫০ আসনে ভোট করতে হলে আরও প্রায় দুই লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে। ইসি সচিবালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে যে প্রকল্প প্রস্তাবটি তৈরি করা হয়েছে, তাতে মোটাদাগে তিনটি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আছে প্রায় দুই লাখ ইভিএম কেনা, ইভিএমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং ইভিএম-সংক্রান্ত জনবল তৈরি। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার কোটি টাকার বেশি।

ইভিএমের বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের অবস্থানকে ‘বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করা’ বলে মনে করছে ইসি। রাজনৈতিক ‘কৌশলের অংশ’ হিসেবে ইভিএমের বিরোধিতা করা হচ্ছে, এমন মনোভাবও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে কাজ করছে। ইভিএমের পক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের সাফাই গাওয়া কাক্সিক্ষত নয়। ‘বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করা’ বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। তাহলে তো বিরোধী দলের সঙ্গে আর সংলাপের কোনোই প্রয়োজন নেই। নির্বাচন কমিশন এককভাবে যেটা ভালো মনে করে সেটাই করুক। অন্যরা যা বলবে সবই ‘বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা’ মনে করা হলে বিভিন্ন দলের সঙ্গে এই সংলাপের মহড়া তাহলে অর্থহীন!

আমরা মনে করি, ইভিএম ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের যে আস্থাহীনতা, তা দূর না করেই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হবে এবং আরেকটি অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করবে।

জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব মূলত শহর এলাকা। সেখানেও ভোট দিতে গিয়ে নানা ঝামেলায় পড়তে হয় ভোটারদের। বিশেষ করে নারী ও বয়স্ক ভোটাররা ইভিএম ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম ঠিকমতো কাজ করেনি। ভোটের পর পরাজিত মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার অভিযোগ করেছিলেন, ইভিএম ‘জালিয়াতির বাক্স’।

সংবিধানিক পদে থেকে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে যেনতেনভাবে জনগণের কষ্টার্জিত টাকার বেহিসাবি অপব্যয় ও অপচয় করা অনুচিত। জনগণের প্রতিটি টাকা হিসাব করে খরচ করতে হবে। যে দেশের মানুষ দুবেলা পেটভরে খেতে পারে না, সে দেশে বছর পরপর ভোটের জন্য মেশিন ক্রয়কে তুঘলকি কাণ্ড ছাড়া আর কী বলা যায়? গরিবের ঘোড়া রোগ বলে একটি কথা আছে।

তাছাড়া ইভিএমএ পুনর্গণনার সুযোগ নেই। ভোট নিয়ে ইসি যে তথ্য দেবে, সেটাই মেনে নিতে হবে। প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে ‘ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে, তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি পুনর্গণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই ইসির গঠন করা কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে সই করেননি।

রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব, যা জাতি হিসেবে আমাদের চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে। যে ইভিএমের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত নয়, সে ইভিএম জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ফল ভালো হতে পারে না। যদি নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে তাদের উচিত হবে ইভিএম কেনার বিলাসী প্রকল্প মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইভিএম কিনতে বিপুল ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক, তা আবারও ভেবে দেখতে হবে। একাদশ নির্বাচনের আগে ইভিএম ক্রয়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার (৪৫০ মিলিয়ন ডলার) মতো ব্যয় হয়েছে। ১৫০টি ইভিএমে নির্বাচন করতে হলে নতুন মেশিন কেনায় অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আগের নির্বাচন কমিশন জনমত উপেক্ষা করে ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম কিনেছিল, যার প্রতিটির দাম পড়ে দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকা। আর ভারতে ব্যবহƒত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা। এ ক্ষেত্রে তারা জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশও পুরোপুরি মানেনি।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইভিএম ক্রয় নিয়ে আবারও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তড়িঘড়ি করে প্রকল্প নেয়ার উদ্দেশ্য কি ইভিএম কেনা, নাকি অন্যকিছু? এর আগে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনেছে বাংলাদেশ। একেকটা মেশিনে ক্রয়ে দুই লাখ ১৩ হাজার টাকার পার্থক্য ছিল। তখন বাংলাদেশ একটি ইভিএম কিনেছে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকায়, সেখানে ভারতে ব্যবহƒত নতুন মডেলের ইভিএমের দাম মাত্র ২১ হাজার ২৫০ টাকা। কোথায় দুই লাখ ৩৪ হাজার, আর কোথায় ২১ হাজার! আবারও ইভিএম নিয়ে দুর্নীতি হবে না, এটা কল্পনা করা যায় কি?

এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের আমলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রযুক্তিবিদদের তৈরি ইভিএম দিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নির্বাচন হয়েছিল। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বাড়াতে বুয়েটকে দিয়েই ইভিএম তৈরি করা দরকার ছিল, যাতে ইসির খরচও কম পড়ত। বুয়েটের ইভিএমে বায়োমেট্রিকে?র মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তকরণের সুবিধা ছিল না। আবার বর্তমানে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ভোটার ভেরিয়েবল অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সুবিধা নেই। এটাই বিরোধী দলের আপত্তির অন্যতম কারণ।

আগের ইসি দাবি করেছিল, গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের ইভিএমের দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম পড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑতাহলে ইভিএম তৈরির জন্য যে কারিগরি পরামর্শক কমিটি করা হয়েছিল, ইসি সে কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি আমলে নেয়নি কেন?

ইভিএমের সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে? দ্বন্দ্ব আর বিতর্কের পাট চুকিয়ে এই মেশিন কি আমাদের অগ্রগতির সহায়ক হবে, না প্রতিবন্ধকÑএই প্রশ্ন দেশপ্রেমিক সর্বসাধারণের।

ইভিএম দিয়ে ভোট গ্রহণে তো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই, তাহলে ইভিএম নিয়ে এত তর্ক, মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও সেটা দিয়ে ভোট গ্রহণের জন্য এত আপ্রাণ চেষ্টা কেন? আর টাকার অঙ্কেও তো কম নয় (আট হাজার কোটি টাকা )। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সরকার যখন সরকারি সেবা ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধন করতে বলছে, তখন এরকম একটি বিতর্কিত বিষয়ে এত অর্থ খরচ না করে শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান, অবকাঠােমো উন্নয়ন, কৃষিতে ভর্তুকি এবং ওএমএসের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে দুস্থ মানুষদের মাঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে ব্যয় করুন। যে টাকা দিয়ে ইভিএম কেনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা তো কোনো রাজনৈতিক দলের টাকা নয়, এ টাকা জনগণের টাকা। সুতরাং জনগণের টাকা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে জনকল্যণে ব্যয় হোকÑএটাই প্রত্যাশা থাকবে।

সাংবাদিক

abunoman1972@gmail.com