প্রতিনিধি, গাজীপুর: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ভোটারদের বিড়ম্বনার কারণ হয় কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। তিনি বলেছেন, ভোটাররা এ মেশিনে ভোট দিতে অভ্যস্ত নন। এ বিষয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নির্বাচন কমিশনের আগাম পদক্ষেপও চেয়েছেন তিনি।
গত কয়েক বছর ধরে বিএনপিসহ সমমনাবিরোধী দলগুলো ইভিএম নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এলেও এই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রার্থী এ ধরনের কথা বললেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোট নেয়ার পরিকল্পনা করলেও সেখান থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন। তবে প্রায় সোয়া এক বছর ধরে স্থানীয় সরকারের প্রায় সব ভোটেই ব্যবহার করা হয়েছে যন্ত্রটি। পাঁচটি সিটি করপোরেশনে যে ভোট হতে যাচ্ছে, তাতেও ব্যালটের বদলে ইভিএম ব্যবহার হবে।
এই পাঁচ সিটির মধ্যে সবার আগে ভোট হবে ঢাকা লাগোয়া জনপদ গাজীপুরে। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পরদিন গতকাল বুধবার সেখানে যান প্রধান নির্বাচন কমিশানর কাজী হাবিবুল আউয়াল। দুপুরে শহরের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার মিলনায়তনে সব মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে অংশ নেন মতবিনিময়ে। এ সময় আজমত উল্লা ছাড়াও কথা বলেন অন্য সবাই।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলেন, ‘গাজীপুরে নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৭ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ইভিএমে তারা আগে কখন ভোট দেয়নি। যুবক যারা রয়েছে তারাসহ আমিও কখনও ইভিএম ভোট দিইনি।’
এই ‘অনভিজ্ঞতার’ সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ চেয়েছেন আজমত। তিনি বলেন, ‘মেয়র ও কাউন্সিলরদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রতি ওয়ার্ডে যেন ভোটারদের ইভিএমের সিস্টেমটা বুঝিয়ে দেয়া হয়। তাহলে ভোটাররা কিছুটা হলেও বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবেন।’
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে দলের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেন নৌকা মার্কার প্রার্থী।
এই মতবিনিময়ে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন কোনো বক্তব্য দেননি। বাকিরা সবাই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কার কথা বলেছেন।
আজমতের সম্ভাব্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে গাজীপুরবাসী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাক্ষী আছে। সে নির্বাচনে বেলা ১১ টার পর থেকে বিএনপির কোনো এজেন্টকে থাকতে দেয়া হয়নি। আমরা বারবার অভিযোগ করেছি। সেই সময় নির্বাচন কমিশন নিশ্চুপ ছিল। তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি এবং কোনো ধরনের উত্তর আমাদের দেয়নি। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি আগামী ২৫ তারিখের নির্বাচনে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে, তাদের কাছে প্রশ্ন আমার।’
জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘আমরাসহ ভোটাররা আশঙ্কা করি নিরপেক্ষ ভোট হবে কি না। … মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো? নির্বাচনে তাল গাছে ভোট দিলে, সেটা বেল গাছে চলে যাবে না তো?’
ভোটাররা এ ধরনের প্রশ্নগুলো করে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এ সরকারের অধীনে অনেক নির্বাচন মানুষের কাছে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। দিনের বেলা এজেন্টদের বের করে দিয়ে পুলিশ দিয়ে সিল মেরেছে। সিভিল প্রশাসন (ম্যাজিস্ট্রেট) গিয়ে দেখেছে ৩০ শতাংশ জাল ভোট পড়েছে, যা খুবই লজ্জাজনক বিষয়।’
২০১৮ বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসন সিল মেরেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘কখনও সিভিল প্রশাসনকে এ ধরনের কাজ করতে দেখি নাই। যারা এসব কাজে বাধা দিয়েছে; তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে।’
বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গহণের পর থেকে অন্যান্য কমিশনের তুলনায় সুন্দর নির্বাচন উপহার দিয়েছে বলেও নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেন লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী। বলেন, ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হোক এটা শুধু আমাদের দাবি নয়, বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের দাবি। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তামাশা করার কোনো দরকার নাই।’
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধান সংকট হলো নির্বাচন। মানুষ ভোট দিতে পারে না। বিগত দিনে কোনো নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারে নাই। আমরা প্রার্থীরা বর্তমান কমিশনের কাছে সুষ্ঠু ভোট প্রত্যাশা করছি। যদি সুষ্ঠু ভোট করতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়, তাহলে আপনারা কী করবেন এটা আমাদের স্পষ্ট করে বলবেন।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে ঘোষণা চাই, ‘গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হলে আমরা পদত্যাগ করব।’
দলীয় দিক দিয়ে অনুগত কাউকে প্রিসাইডিং অফিসার না করার দাবিও জানান আতাউর। তিনি বলেন, ‘ইভিএম আগে আমাদের দেখানো দরকার; তা সঠিকভাবে ফাংশন করবে কি করবে না।’
জাকের পার্টির প্রার্থী রাজ আহমেদ বলেন, ‘ভোট চাইতে গেলে অনেক ভোটাররা অভিযোগ করে বলেন, কেন্দ্রে গেলে ঝামেলা হবে কি না। আমরা সহিংসতা হবে না আশ্বাস দিচ্ছি।’
গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘জনগণের অংশগ্রহণে আমরা সুষ্ঠু একটি নির্বাচন আশা করছি এ কমিশনের কাছে।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন-অর রশীদ চৌধুরী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য একটি ‘টমটম’ ব্যবহার করার অনুমতি চান।
প্রচার ঘণ্টা বাড়ানোর দাবি মতবিনিময়ে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তারা বলেন, শিল্প অধ্যুষিত এলাকার অনেক ভোটার বিভিন্ন কারখানায় চাকরি করেন। তারা রাত ৮টা থেকে ৯টার পর বাসায় ফেরেন। আবার কর্মস্থলে যেতে হয় সকাল ৭টায়। কিন্তু প্রচারের জন্য সময় দেয়া হয়েছে বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। এই সময়ে শ্রমিক ভোটারদের পাওয়া যায় না।
এই যুক্তি দেখিয়ে প্রচারের সময় বাড়ানোর কথা বলেন প্রার্থীরা। অযথা গ্রেপ্তার করে আতঙ্ক সৃষ্টি না করার দাবিও জানিয়েছেন তারা। ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের আগাম ধারণা দেয়া, পোস্টার লেমিনেটিং করার অনুমতি দেয়ার কথাও বলেন কেউ কেউ।
একজন কাউন্সিলর প্রার্থী বলেন, অনেক প্রার্থী ভোটরদের হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যাচ্ছে।
ভোটাররা যেন নির্ভয়ে কেন্দ্রে আসতে পারে, হুমকিতে যেন তাদের ভোট না দিয়ে ফিরে যেতে না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ করেন তারা।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এএফএম কামরুল হাসান ও রিটার্নিং কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার এএসএম জাকির হোসেনের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।
উপস্থিত ছিলেন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম, ডেপুটি কমিশনার আনিসুর রহমান ও পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম।