ইভ্যালিকে ‘দেউলিয়া ঘোষণা’র পরিকল্পনা ছিল রাসেলের : র‌্যাব

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিপুলসংখ্যক গ্রাহক তৈরি করে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির ‘ব্র্যান্ডভ্যালু’ বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মোহাম্মদ রাসেলের। সেই ব্র্যান্ডভ্যালু কাজে লাগিয়ে তিনি কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছে দায়সহ ব্যবসা বেঁচে দেয়ার কথা ভাবছিলেন। তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোরও পরিকল্পনা ছিল তার। আর দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল।

শুক্রবার রাজধানীর উত্তরায় র‌্যাব সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। রাসেলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

আরিফ বাকের নামে এক ব্যক্তি বৃহস্পতিবার ভোরে ইভ্যালির এমডি রাসেল ও তার স্ত্রী ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় প্রতারণার মামলা করেন। পণ্যের জন্য আগাম অর্থ দিয়ে না পাওয়ার পাশাপাশি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ দেয়ার অভিযোগ করা হয় সেখানে।

মামলার বাদী আরিফ বাকের তার অভিযোগে বলেন, ইভ্যালির বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি তিন লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে তাকে কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি।

ওই অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার বিকালে তাদের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরে রেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, একটি প্রতিবেদনে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা ৪০৩ কোটি টাকা বলা হলেও তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তার এক হাজার কোটি টাকা দায় রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনের পর রাসেল ও তার স্ত্রীকে গুলশান থানায় সোপর্দ করা হয়। এর আগেও দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে ইভ্যালি এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়েছে।

র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাসেল ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। পরে তিনি একটি ব্যাংকে চাকরি নেন। ২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে ডায়াপারের ব্যবসা শুরু করেন। ওই ব্যবসা বিক্রি করে তিনি এক কোটি টাকা পান। এই সামান্য টাকা দিয়ে ইভ্যালির কার্যক্রম চালু করেন।

ইভ্যালিতে দুই হাজার স্থায়ী এবং এক হাজার ৩০০ অস্থায়ী কর্মী, অফিস খরচ, ভাড়াসহ মাসে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হতো বলে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন রাসেল।

কমান্ডার মঈন বলেন, এখন পর্যন্ত ইভ্যালি যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, যেসব অফার দিয়ে আসছে, তার যে ব্যবসায়িক কৌশল ছিল, এখন পর্যন্ত উনার কোনো লভ্যাংশ উনি পাননি। ক্রমান্বয়ে উনি দায় বাড়িয়েছেন। উনার প্রতিষ্ঠান এখন দেনাদার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর এক থেকে দুই মাসের আগাম সময় নিয়ে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ‘অফার’ দেয়া শুরু করেছিল ইভ্যালি। তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি, প্রাইভেটকারসহ নানা পণ্যের ক্রেতাদের সমারোহ ঘটেছিল ইভ্যালিতে।

স্বল্প মূল্যের এসব পণ্যের জন্য টাকা নেয়া হতো অগ্রিম। কিন্তু কিছু ক্রেতাকে পণ্য দিয়ে বাকিদের অপেক্ষায় রাখার কৌশল নিয়ে তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। এখন এ কোম্পানির দায় দাঁড়িয়েছে সম্পদের কয়েকগুণ বেশি।

গ্রাহকদের অর্থ কীভাবে ফেরত দেবেন সে ব্যাপারে রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল র‌্যাব। কিন্তু তিনি কোনো ‘সদুত্তর’ দিতে পারেননি বলে কমান্ডার মঈনের ভাষ্য। তিনি বলেন, মানুষের কাছ থেকে যেভাবে অগ্রিম অর্থ বা পণ্য নিয়েছেন তা ফিরিয়ে দেয়া জটিল বলে রাসেল স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকরা যখন প্রতারিত হচ্ছিলেন, পণ্য  পাচ্ছিলেন না, তখন হঠাৎ করে ‘টি টেন’ ‘টি সেভেন’ ‘টি ফাইভ’ নামে অফার ঘোষণা করে ইভ্যালি। এসব অফারের মাধ্যমে আসলে সাধারণ পণ্য দেয়া হতো। র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, রাসেলের বক্তব্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারির পর বড় কোনো পণ্য গ্রাহককে তারা দিতে পারেননি।

অনেকের সঙ্গে রাসেলের যোগাযোগ থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, এটা রাসেলের মার্কেটিং পলিসি ছিল। দক্ষিণ এশিয়াতে ইভ্যালিকে সবাই এক নামে চিনবে- এমনটা রাসেল চেয়েছিলেন। উনি মার্কেট ভ্যালু তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সিএসআরের মাধ্যমে তিনি স্পন্সর করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রচার প্রচারণা করেছেন। এই প্রচার প্রচারণা তার সম্পূর্ণটাই সাধারণ জনগণের লগ্নিকৃত অর্থের মাধ্যমে করেছেন, লভ্যাংশ থেকে করেননি।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যেসব কোম্পানি ই-কমার্সে বিনিয়োগ করে, ইভ্যালিতে তাদের বিনিয়োগ পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল রাসেলের। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

তিনি বলেন, গ্রাহক সংখ্যা দেখিয়ে ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করতে তাদের প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলেন রাসেল। দেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে উৎসাহিতও হয়েছিল। কিন্তু তারা ভেতরে ঢুকে দেখল, ইভ্যালির যে পরিমাণ দায়, সেখান থেকে উত্তরণ বেশ কষ্টসাধ্য।

রাসেল এবং তার স্ত্রী পদাধিকার বলে মাসে পাঁচ লাখ টাকা করে বেতন নিতেন এবং কোম্পানির টাকায় দুটি রেঞ্জ রোভার ও অডি গাড়ি ব্যবহার করতেন। সাভারে রাসেলের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি থাকলেও তার নিজের নামে কোনো ফ্ল্যাট নেই বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় সরবরাহকারী কোম্পানি ও গ্রাহকদের কাছে কয়েকশ’ কোটি টাকার দায়ে পড়েছে ইভ্যালি। এত অল্প সময়ে এই বিপুল টাকা কোথায় গেল, তার হদিস এখনও মেলেনি। আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০