রহমত রহমান: দেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্টের (ই-সিগারেট ও এইচটিপি) ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ ও যুবসমাজ এতে আসক্ত হচ্ছে। বিড়ির চেয়ে কম ক্ষতিকর নয় ইমার্জিং টোব্যাকো সিগারেট। ফলে আসন্ন মহামারি বিবেচনা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এরই মধ্যে অনেক দেশ ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে ইমার্র্জিং টোব্যাকো নিষিদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই, নেই নজরদারি।
এ সুযোগে অভিজাত এলাকায় কৌশলী প্রচার-প্রচারণার কারণে দেশে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নজরদারি বৃদ্ধি বা নিষিদ্ধ না করলে তামাকজনিত মৃত্যুহার বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুবসমাজ। উদ্বেগের বিষয় হলো দেশে ইমার্জিং টোব্যাকো নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কোনো বিধান নেই। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’র খসড়ায় ই-সিগারেট নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছে।
সূত্রমতে, বাজারে দুই ধরনের ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (এন্ডস) এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপিএস)। এন্ডস এক ধরনের ব্যাটারিচালিত ডিভাইস, যা ই-লিক্যুইড বা নিকোটিনযুক্ত তরল দ্রবণকে তাপের মাধ্যমে বাষ্পে রূপান্তরিত করে। একজন ব্যবহারকারী যখন ডিভাইসটিতে টান দেয়, তখন নিকোটিনের দ্রবণ গরমে বাষ্পীভূত হয় এবং ব্যবহারকারীকে নিকোটিন সরবরাহ করে। এতে নিকোটিন ছাড়াও নানারকম রাসায়নিক মিশ্রণ এবং সুগন্ধি মেশানো থাকে, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা ভ্যাপ পেনস্, ই-হুক্কা, ই-পাইপ এবং ই-সিগার প্রভৃতি এন্ডস পণ্যের বিভিন্ন ধরন। সাধারণ সিগারেট বা পাইপ আকৃতি ছাড়াও এগুলো দেখতে কলম, পেনড্রাইভ, বিভিন্ন খেলনা কিংবা সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে। আর এইচটিপিএস ইলেকট্রনিক ডিভাইসভিত্তিক এক ধরনের তামাকপণ্য। তামাকযুক্ত স্টিক বা প্লাগ থেকে তাপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিকোটিন এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত ধোঁয়া গ্রহণ করা হয়। এতে তামাকের সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য ও সুগন্ধি মেশানো হয়। এইচটিপিএস ডিভাইসে ধূমপানের জন্য তামাক এবং এন্ডসে সরাসরি নিকোটিন দ্রবণ মেশানো হয়ে থাকে।
সূত্রানুযায়ী, দেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যবহার তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, এমনকি বিভিন্ন মার্কেট ও রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার উদ্বেগজনকহারে চোখে পড়ছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয় কেন্দ্র। দারাজ, বিক্রয় ডট কমসহ বিভিন্ন অনলাইনে প্রকাশ্যে ই-সিগারেট বিক্রি হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে হোম ডেলিভারি। এছাড়া ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রি ও হাতবদল হচ্ছে। বিক্রি বাড়াতে হচ্ছে কনফারেন্স ও প্রদর্শনী। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে ভ্যাপ ইমপোর্টাস অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ভিআইটিএবি) নামে একটি সংগঠনও গড়ে উঠেছে। এছাড়া শুল্ককর ফাঁকি দিতে মিথ্যা ঘোষণায় চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইমার্জিং টোব্যাকো দেশে আসছে। যদিও এসব পণ্য ব্যবহারের মাত্রা কতটা বিস্তার লাভ করেছে, সে বিষয়ে সবশেষ কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ই-সিগারেটকে সুনিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট, ২০১৬-তে ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সব পণ্যকে অনিরাপদ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভ্যাপিং-সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে মহামারির আকার ধারণ করলে এই ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টগুলোর সত্যিকারের চেহারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী এ বছর ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির দুই হাজার ১৭২ জনের ফুসফুসজনিত রোগ এবং ৪২ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র থাকার কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়–য়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে রক্ষা করতে ই-সিগারেটসহ সব ভ্যাপিং এবং হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা। এছাড়া নিয়মিত মনিটরিং, জরিপ বা গবেষণার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তার দাবি জানানো হয়েছে।
প্রজ্ঞার তথ্যমতে, এরই মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩০টির অধিক দেশে এসব পণ্য নিষিদ্ধ। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে এই বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।