ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও গুপ্তহত্যার প্রভাব

মো. জাফর আলী : পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার পর্বতপ্রধান একটি দেশ ইরান। সৌদি আরবের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম ও এক উদীয়মান শক্তিশালী দেশ এটি। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার এদেশে থাকার কারণে তেল-গ্যাস রপ্তানি করে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নিজস্ব অর্থনীতিকে বেশ অগ্রগামী করে চলছে ইরান। ১৬ লাখ ৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দেশটি আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও তুরস্কের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এজন্য ভৌগোলিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে দেশটি। বিশেষ করে, হরমুজ প্রণালির নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে থাকার কারণে অধিকতর গুরুত্বের দাবিদার এ ভূখণ্ড, কারণ এই হরমুজ প্রণালি দিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ তেল সরবরাহ করা হয় (যা প্রতিদিনের হিসেবে দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ ব্যারেলে)।

যাহোক, ১৯৭৪ সালে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অ্যাটমস ফর পিস প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাদের পরমাণু কর্মসূচির সূচনা ঘটায়। এভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হতে অবশেষে ১৯৯৫ সালে রাশিয়ার সহায়তায় ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সময় পারমাণবিক কার্যক্রম জোরালো হয় এবং ধাপে ধাপে উন্নীত হতে থাকে। উল্লেখ্য, ইরান বরাবরই তাদের এ কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর একসময় যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরোধিতা করা শুরু করলে উত্তেজনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে বিশ্বের এই পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ইরানের অর্থনীতি অনেকটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, যার কারণে ২০১৫ সালে ইরান এই পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে, তথা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি-সংক্রান্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে ইরান তার কার্যক্রম সীমিত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পরমাণু কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়। বিনিময়ে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অবরোধ তুলে নেয়। আর এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর ইরানের রপ্তানির হার বেড়ে যাওয়ায় প্রথম বছরেই প্রকৃত জিডিপি, অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল ১২ শতাংশ হারে। এভাবে অর্থনীতিতে তাদের বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনকালে এই চুক্তিটি সংঘটিত হয়েছিল, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র ইসরাইল কখনও মেনে নিতে পারেনি। কারণ ইসরাইল ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত না করে একবারে বন্ধ করে দেয়ার গভীর স্বপ্নে নিমজ্জিত। এর কিছু কারণও থাকতে পারে, তা হলো ইসরাইল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি ইরান কখনোই দেয়নি এবং সবসময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। আর প্রতিবেশী দেশের এরকম শত্রুভাবাপন্ন আচরণ ও সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ইসরাইলকে সর্বদাই আতঙ্কিত করেছে। পাশাপাশি সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেন প্রভৃতি দেশগুলোয় ইরানের সামরিক প্রভাব ইসরাইলকে অনেকটা চিন্তায় ফেলেছে। এজন্য ইরানের পরমাণু কার্যক্রমকে নস্যাৎ করার অংশ হিসেবে কৌশল করে ইসরাইল বেশ কয়েকবার ইরানের পারমাণবিক চুল্লিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তাছাড়া ইরানের মাটিতে গুপ্তচরভিত্তিক বিভিন্ন মিশন পরিচালনা করে ইরানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বিজ্ঞানীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিরুদ্ধে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের আইআরজিসি’র প্রধান জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।

বারাক ওবামা সরকারের পর ইসরাইলের একনিষ্ঠ শুভাকাক্সক্ষী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসেন। তিনি ২০১৫ সালে ছয় দেশের সঙ্গে ইরানের করা চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন ডলার কেনা, স্বর্ণ ও অন্যান্য ধাতুর ক্রয়-বিক্রয়, ইরানি রিয়াল, জ্বালানি ও ব্যাংক-সম্পর্কিত লেনদেনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাতে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

এখন কথা হচ্ছে, চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়া, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ওই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও ইসরাইলের কথিত গুপ্তহত্যা বা গুপ্তচরভিত্তিক কার্যক্রম, অথবা আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ ইরান ও ইরানের জনগণকে আসলে কীভাবে প্রভাবিত করছে? এর উত্তরে বেশ কয়েকটি দিক পর্যালোচনা করা যেতে পারে

এক. ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির করা চুক্তি থেকে বের হওয়া এবং ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করাটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও কৌশলগত ভুল, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় বন্ধু রাষ্ট্রগুলোসহ পুরো বিশ্ব এই কাজগুলোর নিন্দা জ্ঞাপন করে এর বিরোধিতা করেছে। এ কারণে ইরান সুযোগ পেয়ে চুক্তি ভঙ্গ করার বৈধতা পেয়ে ক্রমেই পরমাণু কর্মসূচি নবায়ন করার সাহস পেয়েছে, অর্থাৎ চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী পশ্চিমা দেশগুলোকে তোয়াক্কা না করেই ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও মজুতের পথে পা বাড়িয়েছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরোধিতা করার কারণে সময়ে-অসময়ে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ দুই দেশ রাশিয়া ও চীনকে ইরানের পক্ষে থাকতে দেখা গেছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বিশ্বের অন্যতম দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও ভালো হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই. কোনো দেশের অভ্যন্তরে গুপ্তচরভিত্তিক মিশন পরিচালনা করে পারমাণবিক অথবা যেকোনো স্থাপনায় আঘাত কিংবা বিভিন্ন বিজ্ঞানী বা শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করাটা মূলত ওই দেশকে ভবিষ্যতে ওই দুর্ঘটনাগুলো থেকে বাঁচার বিকল্প পদ্ধতির ব্যাপারে কল্পনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পথ বের করে দেয়। সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে যা মূলত ওই দেশের কার্যক্রমকে ব্যর্থ করার পরিবর্তে সফলতার দিকে নিয়ে যায় এবং আরও কঠিন পদক্ষেপ নিতে সহযোগিতা করে, ঠিক যেমনটা হয়েছে ইরানের বেলায়। সম্প্রতি ইরানের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ ও সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে বিপ্লবী গার্ডসের জ্যেষ্ঠ কমান্ডারকে হত্যা করার পর, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বায়না ধরে ইরান সরকার ২০ শতাংশ হারে ইউরেনিয়াম বৃদ্ধি করা এবং তাদের দুটি পরমাণু কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্যে উন্নত সেন্ট্রিফিউজ বসানোসহ পরমাণু উৎপাদন কেন্দ্রে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক পরিদর্শন বন্ধ করতে এরই মধ্যে সংসদে আইন পাস করেছে। তাছাড়া কিছুদিন আগে ইরান তাদের তৈরি করা ভূগর্ভস্থ এক বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র শহরের ভিডিও প্রকাশ করে বিশ্বদরবারে সামরিক সক্ষমতার আরও একটি প্রমাণ পেশ করেছে। এককথায় ইরান অর্থনৈতিক দিক থেকে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন হলেও সামরিক খাতে তাদের এত বিনিয়োগ এক ধরনের সফলতার কথাই প্রমাণ করে, যা তাদের শত্রুদের চাওয়া-পাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত।

তিন. ইরানের সার্বভৌমত্বে একের পর এক আঘাত হানা ইরানি জনগণকে জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে ভাবিয়ে ও ঐক্যবদ্ধ করানোর মাধ্যমে এক ধরনের দেশপ্রেম ও শক্ত জাতীয়তাবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার শিক্ষাই যেন দিচ্ছে। পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থবিরোধী ওই ঘটনাগুলো ঠাণ্ডা মাথায় ইরান সরকার কর্তৃক মোকাবিলা করা এবং সূক্ষ্ম পররাষ্ট্রনীতির জন্য সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভিত যেন ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ইরানের বিরুদ্ধে সংঘটিত এরকম ঘৃণিত কার্যকলাপ মূলত ইরানের প্রতি এক ধরনের মানবিক ও বৈশ্বিক সমর্থন অর্জনের পথকে সুগম করে দেয়।

শিক্ষার্থী

শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

mdjaforalip5@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০