Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:21 pm

ইরান কেন রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একটি দেশের সঙ্গে অপর একটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুধু সম্পর্কে বিরাজমান থাকে না। এ সম্পর্কের গুরুত্ব ও ব্যাপকতা অনেক গভীর। কারণ একটি দেশের সঙ্গে অপর একটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত থাকে। দুদেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া বিনিময়, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সমন্বিত চুক্তি ইত্যাদি বিষয়ের মাধ্যমে দুইটি দেশের কূটনীতিক মেলবন্ধনের নির্মাণ ঘটে। বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় কূটনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক। দুইটি দেশ তাদের দেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার ফলে ওই সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রা পায় বৈশ্বিক মানচিত্রে। এতে দুদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক মহলে একদিকে যেমন সমৃদ্ধ হয় তেমনি দুদেশের সাধারণ মানুষও এই সম্পর্কের সুবিধা ভোগ করে।

রাশিয়া আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ একটি দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়ার অবস্থান প্রথম সারির মধ্যে। রাশিয়াতে বর্তমানে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা প্রচলিত। প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, কয়লা ইত্যাদির বিশাল ভাণ্ডার রাশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। রাশিয়ার অর্থনীতি বিশ্বে দশম বৃহত্তম। একুশ শতকের শুরু থেকে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ভারসাম্য এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা রাশিয়ার অর্থনীতির ব্যাপকায়নে ভূমিকা রেখেছে। আমদানি, রপ্তানি, সমৃদ্ধ সমরাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রনির্ভর দেশ হওয়ায় রাশিয়া বৈশ্বিক পাওয়ার হাউস দেশগুলোর  একটি। ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশেই রাশিয়াকে অত্যন্ত সমীহ করে।

ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত  একটি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিগণিত হয় তেহরান। তাছাড়া শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান বর্তমান বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে বেশ অগ্রসরমান একটি দেশ। তেহরান পশ্চিমা দেশগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চলমান রেখেছে।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সব জল্পনা কল্পনার অবসান ও সব শঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ করে। যে আক্রমণের দ্বারা আরম্ভ হয় রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দীর্ঘ যুদ্ধ। যে যুদ্ধ বর্তমানে এখনও চলমান রয়েছে। শিগগিরই যে এই যুদ্ধের ফলপ্রসূ সমাধান হবে তা বলা মুশকিল। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক তথা পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ইউক্রেনের প্রতি থাকবে। তা অনুমিত সত্য। পশ্চিমা দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার দ্বারা যুদ্ধে বেশ ভালোভাবে টিকে রয়েছে কিয়েভ। অপরদিকে মস্কোও হাল ছেড়ে দিচ্ছে না। নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধের লাগাম নিজেদের ঢেরায় ধরে রাখতে চাইছে পুতিন প্রশাসন। স্বাভাবিকই রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে সমগ্র বিশ্বে। এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বিশ্ববাসীর মধ্যে।

রাশিয়া হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ইউক্রেনও কৃষি খাতে ইউরোপে সমৃদ্ধ একটি দেশ। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাশিয়া ও ইউক্রেনের শস্য আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনা এ দুই দেশের ওপর নির্ভর ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ফলে গত বছর থেকে সেই চিত্র অনেকখানি বদলে গেছে। আবার রাশিয়ার গ্যাস নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের দ্বারা ইউরোপের সিংহভাগ দেশগুলোতে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো ধীরে ধীরে রাশিয়ার ওপর গ্যাসনির্ভরতা কমিয়ে ফেলে। পশ্চিমা দেশগুলো আরও বেশি দামে গ্যাস সরবরাহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ফলে মোট দাগে বলা যায় যে, রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ কৃষি খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর জের ধরে বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে আকাশচুম্বী। বিদ্যুৎ ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র বিশ্বে। এ সময়ে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির দরপতনও দেখেছে বিশ্ব।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতিসহ সব খাতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে পুতিন প্রশাসন দারুণভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সেই সংকট মোকাবিলায়। এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা জোট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিরাট নিষেধাজ্ঞার শিকার হয় মস্কো। এতে রুশ প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয়। মস্কো তাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিগুলো কাজে লাগাতে চাইলেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ বেড়েই যাচ্ছে শুধু।

অপরদিকে তেহরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির নিজেদের সর্বাবস্থায় জড়িয়ে রাখায় পশ্চিমা দেশগুলো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয় তেহরান।

তদুপরি ড্রোন প্রযুক্তিতে দেশটির সাফল্য নজরকাড়া।

২০২২ সালে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়া দুইটি দেশ হচ্ছে রাশিয়া ও ইরান। রাশিয়া ও ইউক্রেন দেশ দুইটির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার কূটনীতিক সম্পর্ক ভিন্ন মেরুকরণে দাঁড় করিয়েছে। বলা হয়, রাশিয়া ও ইরানের শত্রুরাই দেশ দুইটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে। দুইটি দেশই পশ্চিমা জোট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো নিষেধাজ্ঞার পাহাড় নিয়ে চলছে। এমতাবস্থায় দেশ দুইটির নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সম্প্রতি ইরানে রাশিয়ার পণ্য সরবরাহ বেড়েছে ২৭ শতাংশ। আর রাশিয়ায় ইরানের পণ্য সরবরাহ বেড়েছে ১০ শতাংশ। তাছাড়া রাশিয়া ইরানকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমসহ একটি স্যাটেলাইটও দিয়েছে রাশিয়া। আবার রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের নিজেদের তৈরিকৃত ড্রোন কামিকাজি দিয়ে সহায়তা করেছে মস্কোকে। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ধারণা করছে রাশিয়া ইরানকে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির ফর্মূলা দিয়ে সহায়তা করছে। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রসহ সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তা ইসরাইলসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

আরেক এশীয় শক্তিধর দেশ ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেলসহ বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় করে দেশটির অর্থনীতি সচল রাখতে সহায়তা করছে। কিন্তু সাগরপথে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই বাণিজ্য কঠিন হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর কারণে। এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে ইরান। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে ব্যবহার করে পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরের মধ্য দিয়ে ভারতে পণ্য আনতে পারবে রাশিয়া। এই উদ্দেশ্যে  ইন্টারন্যাশনাল নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর বা আইএনএসটিসি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে তারা। এতে সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হবে।

আবার ইরানের সঙ্গে রাশিয়া সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতেই বেশি আগ্রহী হবে। কেননা, প্রধান প্রধান সব সমুদ্রপথেই পশ্চিমাদের আধিপত্য রয়েছে, আর রাশিয়ার জাহাজের ওপর বিধিনিষেধও দিয়ে রেখেছে তারা। এরপরও ক্রেমলিন বিকল্প পথ খোলা রাখছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ‘জ্বালানি, পরিবহন ও লজিস্টিক খাতে যৌথ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন’ বলে ঐকমত্যে পৌঁছান। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতেও ইরান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার দরুন রাশিয়া, ইরান পরস্পর যেমন  লাভবান হবে তেমনি বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় উত্তেজনা চরমে ওঠে কি না তাও বলা যায় না।

শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়