নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্তের গরমিল নতুন কিছু নয়। এবার ইসলামি ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রকাশিত দুটো প্রতিবেদনে একই সময়ের তথ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। এই দুটি প্রতিবেদনে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানতের গরমিল পাওয়া গেছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গরমিল পাওয়া গেছে ৩২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক নিয়ে প্রতি ত্রৈমাসিক ও মাসিক দুইটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিকে ‘কোয়াটারলি রিপোর্ট অন ইসলামি ব্যাংকিং বাংলাদেশ’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আর মাসিকভিত্তিক ‘ইসলামি ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স স্ট্যাটিস্টিকস’ বা আইবিএফএস প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
দুইটি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ত্রৈমাসিক প্রকাশিত কোয়াটারলি রিপোর্ট অন ইসলামী ব্যাংকিং বাংলাদেশ তথ্য দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। তবে গতকাল বুধবার মাসিকভিত্তিক প্রকাশিত ইসলামি ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স স্ট্যাটিস্টিকস প্রতিবেদনে ডিসেম্বর-ভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি দেখানো হয় ৪ লাখ ২২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই প্রতিবেদনেই ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আমানতে গরমিল ২০ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।
এছাড়া এসব ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের তথ্যেও গরমিল পাওয়া যায়। ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে মোট বিনিয়োগের স্থিতি দেখানো হয় ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। মাসিকভিত্তিক প্রতিবেদনে একই সময়ে বিনিয়োগের স্থিতি দেখানো হয় ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এখানে গরমিল পাওয়া যায় ৩২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট তাদের নিজস্ব চাহিদামতো তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এতে দেখা যায়, একই তথ্য একই ব্যাংক থেকে একেক ডিপার্টমেন্টকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সরবরাহ করা হয়, যার কারণে তথ্যের এই গরমিল তৈরি হয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলোর একটি তথ্যকেন্দ্র থাকা দরকার। যেখান থেকে সব তথ্য সরবরাহ করা হবে। এতে ভুল তথ্য প্রবাহ কমে আসবে।
এর আগে ২০২২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের তথ্যেও ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। ওই বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে মোট ২৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিল ঋণের তথ্য প্রকাশ করে। তবে একই বছরের আর্থিক স্থিতিশীল প্রতিবেদনে ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিল ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। দুটো প্রতিবেদনে তথ্যের গরমিল ছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা।
এদিকে, গরমিল তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক খাতের বিভিন্ন তথ্য প্রকাশও বন্ধ রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট খুঁজে দেখা গেছে, পণ্যভিত্তিক আমদানির এলসি বা ঋণপত্রের তথ্য প্রায় দুই বছর ধরে প্রকাশ করেনি। সর্বশেষ ২০২২ সালের জুলাইয়ে পণ্যভিত্তিক ঋণপত্রের তথ্য প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। এরপর আর পণ্যভিত্তিক আমদানির ঋণপত্রের তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। এর আগে প্রতি মাসেই ওয়েবসাইটে আগের মাসের তথ্য দেয়া হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ২০২২ সালে দেশে ডলার সংকট হয়। ওই সময় আমদানিতে কড়াকড়ি করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কড়াকড়ির কারণে অনেক আমদানি পণ্য কমে যায়। পণ্য আমদানি কমার খবর যাতে প্রকাশ না হয়, তাই তথ্য সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, যাতে পরিস্থিতি খারাপ না হয়।
বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, গত ছয় মাস ধরে ব্যাংকভিত্তিক আমানত ও ঋণের তথ্যও প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরে সর্বশেষ ব্যাংকভিত্তিক আমানত ও ঋণের সুদহারের তথ্য প্রকাশ করেছে। এরপর আর ব্যাংকভিত্তিক আমানত ও ঋণের সুদহারের তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। অথচ আগে প্রতি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ ওয়েবসাইটে আগের মাসের তথ্য দেয়া হতো।
এছাড়া শিল্পঋণ ও এসএমই ঋণের তথ্য প্রকাশেও অনীহা দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি তিন মাস পরপর এসব তথ্য প্রকাশ করত। সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) পর্যন্ত শিল্পঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এরপর চারটি প্রান্তিক পেরিয়ে গেলেও কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। একইভাবে এসএমই ঋণেরও তথ্য প্রকাশ বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটি সর্বশেষে গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকের এসএমই ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাছাড়া ব্যাংক খাতে কী পরিমাণ আমানত ও ঋণ রয়েছে, তারও একটি তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ফেব্রুয়ারির পর থেকে তাও প্রকাশ করছে না সংস্থাটি।
সম্প্রতি তথ্য হালনাগাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, এসব রেগুলার হালনাগাদ হওয়ার কথা। কিন্তু কী কারণে হচ্ছে না, তা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানাতে হবে।
নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা না হলে তার ফল কী হতে পারে সে বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নিয়মিত যদি তথ্য প্রকাশ করা না হয়, তাহলে অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হবে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে, দেশের অর্থনীতির অবস্থা প্রকৃতই খারাপ, যে কারণে এসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। এর বাইরে আরেকটি বিষয় ঘটবে। তা হচ্ছে, স্বার্থান্বেষী মহল যাদের সাধারণত সিন্ডিকেট বলে আখ্যায়িত করা হয়, তারা দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে নানা ফায়দা নেয়ার সুযোগ পাবে। কারণ তারা কোনো না কোনোভাবে এসব তথ্য পেয়ে যাবে এবং বাজার অস্থিতিশীল করে তুলবে। তথ্য প্রকাশ না করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেক ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের সহযোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।’