নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকিং ক্রমবর্ধনশীল। বর্তমানে এর বাজার অংশীদার ২০ শতাংশ। মূলধারার ব্যাংকগুলোও তাই শরীয়াহভিত্তিক এ ব্যাংকিং মডেলকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে দেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মূলধারার ব্যাংকিং খাতের প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশের মতো মিশ্র অর্থনীতির দেশে ইসলামি ব্যাংকের প্রসার অব্যাহত রাখতে বেশ কতগুলো চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘ইসলামি ব্যাংকিং অপারেশনস অব ব্যাংকস-২০১৬’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তাদের আলোচনায় এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
গত তিন বছরের (২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬) মূলধারার ব্যাংকিং ও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মো. আলমগীর। প্রধান অতিথি হিসেবে কর্মশালার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরীর সভাপতিত্বে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পরামর্শক এম আজিজুল হকসহ ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন।
প্রতিবেদনে ২০১৬ সালে মূলধারার ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পারফরম্যান্সকে তুলনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায় বেশ কয়েকটি মানদণ্ডে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক খাত।
প্রতিবেদনে ইসলামি ব্যাংকের আর্থিক ও পরিচালন অগ্রগতি সম্পর্কে বলা হয়, অন্যান্য সাধারণ ব্যাংকের তুলনায় ইসলামি ব্যাংকিং সবদিক দিয়েই লাভজনক। ২০১৬ সালে সাধারণ ব্যাংকিংয়ে নেট প্রফিট মার্জিন যেখানে এক দশমিক নয় সেখানে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে তিন দশমিক ছয় শতাংশ। একইভাবে মোট সম্পদের বিপরীতে সাধারণ ব্যাংকিংয়ে আয় পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। অন্যদিকে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে সাত দশমিক তিন শতাংশ।
বিআইবিএম বলছে, ইসলামী ব্যাংকিংয়ে খেলাপি ঋণের হারও অনেক কম। ২০১৬ সালে অন্যান্য সাধারণ ব্যাংকিংয়ে খেলাপি ঋণের হার যেখানে নয় দশমিক দুই শতাংশ সেখানে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে চার দশমিক তিন শতাংশ।
দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ইসলামি ব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে বিআইবিএমের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মোট ১৯ দশমিক চার শতাংশ ইসলামি ব্যাংকিং। বাংলাদেশ বিশ্বের ১০ নম্বরে অবস্থান করছে। যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সুদান ও ইরান। তারা শতভাগ ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চলছে। সৌদি আরবের অবস্থান চতুর্থ। যাদের ৫১ দশমিক এক শতাংশ ইসলামি ব্যাংকিং। এ র্যাংকিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান ১৩ নম্বরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিএআর) ১০ দশমিক আট শতাংশ যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বনি¤œ সীমার একটু বেশি। অথচ এ ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংকের সিএআর ১২ দশমিক সাত শতাংশ। তবে আর্থিক প্রসার সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী জঙ্গি তৎপরতার সহযোগী হিসেবে ইসলামি ব্যাংকিং সন্দেহের মুখে পড়েছে। এ জন্য বর্তমানে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে ।
বাংলাদেশে পরিচালিত ইসলামি ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন বক্তারা। এ খাতে অমুসলিম কর্মীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। নারী কর্মীর সংখ্যা নগণ্য। তা ছাড়া গ্রাহকদের মধ্যে শরীয়াহ্ভিত্তিক অর্থনৈতিক জ্ঞানের অভাব দূর করতে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না।
বিআইবিএমের অধ্যাপক (সাপ্লিমেন্টারি) মুহাম্মদ ইয়াসীন আলী বলেন, ‘বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। মূলধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনেক পরে, ১৯৮৩ সাল থেকে এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হলেও বর্তমানে এর মার্কেট শেয়ার প্রায় ২০ শতাংশ। এটি একটি অর্থনৈতিক মডেল। ধর্ম এখানে বড় কথা নয়। তাহলে এইচএসবিসি, এসসিবি’র মতো বিদেশি ব্যাংকগুলো শরীয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং করতো না। সারা বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অমুসলিম গ্রাহকের সংখ্যা ৬০ শতাংশ। সুতরাং আমাদের দেশের ইসলামি ব্যাংকের গ্রাহক হতে হলে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের লোক হতে হবে, এ সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারী কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবেই কল্যাণমুখী ব্যাংক হিসেবেএ দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটবে।’
ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ক কনসালট্যান্ট আজিজুল হক বলেন, ‘একটি অর্থনৈতক মডেল। শরীয়াহ্ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংককে দুটি দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করা যেতে পারে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও আর্থ-সামাজিক অন্তর্ভুক্তি। আমাদের মতো মিশ্র অর্থনীতির দেশের জন্য দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বাঞ্ছনীয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসলামী অর্থনীতির ‘মাদার’ হচ্ছেন বেগম খাদিজা (রা.)। সুতরাং এ ধরনের ব্যাংকিং সেবায় নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ তুচ্ছ করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।’
ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নীতিমালা (গাইড লাইন) থাকলেও নেই কোনো নির্দিষ্ট আইন (অ্যাক্ট)। কর্মশালায় বক্তারা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন।
Add Comment