ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

ইসমাইল হোসেন রাহাত: ব্রিটিশ শাসনকালে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতারা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নানামুখী প্রচেষ্টা শুরু করেন। ১৯২০ সালে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের পটিয়ায় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফান্ড গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে মাওলানা শওকত আলী মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯৪১ সালে মাওলা বক্স কমিটি ইউনিভার্সিটি ইসলামিক লার্নিং প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে। ১৯৪৯ সালে মওলানা আকরম খাঁ কমিটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে। ১৯৬৩ সালে ৩১ মে ড. এম এম হোসাইনের সভাপতিত্বে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করা হয়। পাকিস্তান শাসনামলে নানাবিধ সমস্যার কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

বহু কমিশন গঠন ও বহু প্রস্তাবের পরেও যখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, তখন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৪ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে ১ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৭ সালে ২৭ জানুয়ারি এম এ বারীকে সভাপতি করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়। ২০ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে এই কমিটি একটি রূপরেখা প্রস্তুত করে সংসদে উপস্থাপন করে। ১৯৭৭ সালে মক্কায় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় করার সুপারিশ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ নভেম্বর ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে ১৭৫ একর জমির ওপরে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী বছর জাতীয় সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ১৯৮১ সালে এ এন এম মোমতাজ উদ্দীনকে উপাচার্য করে দুটি অনুষদের অধীনে চারটি বিভাগে ৩০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে আটটি অনুষদের অধীনে ৩৬টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার।

১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর থেকে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে নিয়ে আসেন। কুষ্টিয়ার স্থানীয় জনসাধারণের আন্দোলনসহ নানাবিধ কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুরের বোর্ড বাজার থেকে কুষ্টিয়ার শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে স্থানান্তর করা হয়। শিক্ষার্থীদের প্রবল অনিশ্চা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে আসা হয়। তৎকালীন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানান্তরকে মনে প্রাণে মেনে নেয়নি। তারা রাজপথে নেমে এসেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানান্তরকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। তারা চেয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীতে হোক এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করুক।

ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর আদলে গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা পাঠের বাইরে ক্যাম্পাসের সুজলা সুফলা পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেট ও ভিসি ভবনসহ প্রায় ভবনগুলোই মুসলিম স্থাপত্যে নির্মিত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন রয়েছে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তর মসজিদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ইতিহাস ও তার সূচনা হয়েছিল বহু স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। দেশের কত আলেমের নির্ঘুম রাত কেটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পেছনে তা লুপ্ত হলেও বিরল হয়ে রয়েছে ইতিহাসের সোনালি পাতায়।

যে লক্ষ্য নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিজ বুনন হয়েছিল, তা আজ লুপ্ত, সেই মহান লক্ষ্যের সিকি তুল্যও বাস্তবায়ন হয়নি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যে অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়, তা আজও অস্পষ্ট লাগছে।

আজ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৪৪ বছরে পদার্পণ করবে। এ পথচলায় যেমন রয়েছে প্রাপ্তি, তেমন রয়েছে প্রত্যাশাও। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবদান রেখে চলছে। শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, খেলাধুলা ও গবেষণায় দেশ ও দেশের বাইরে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলছে। সব ধর্মের মানুষের কাছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল হিসেবে পরিচিত। পিছিয়ে পড়া মাদরাসা শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব অনুষদ কাজ করে যাচ্ছে। এ যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সমাবর্তন ২৭ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে, দ্বিতীয় সমাবর্তন ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে, তৃতীয় সমাবর্তন ২৮ মার্চ ২০০২ সালে এবং সর্বশেষ ৪র্থ সমাবর্তন ৭ জানুয়ারি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যন্ত ১৩ জন ভিসি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে ১৩তম ভিসির দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর ড. শেখ আবদুস সালাম।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও আন্তর্জাতিক র?্যাংকিংয়ে পিছিয়ে, ২১৮৮তম ও জাতীয় পর্যায়ে ২৫তম অবস্থানে। যেখানে বিশ্বায়নের ফলে শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে পিছিয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একটি। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে নতুন বইয়ের সংযুক্তি হচ্ছে না, লাইব্রেরিকে ডিজিটাইজেশন করার উদ্যোগ নিলেও অবজ্ঞায় পড়ে রয়েছে ল্যাবের কম্পিউটারগুলো। প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষার্থীরা পায়নি  প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইল। ফলে ই-লার্নিং, গবেষণা ক্ষেত্র ও শিক্ষাবৃত্তিসহ অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটি সময়োপযোগী নয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তথ্য ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত বিশদ তথ্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত কোনো গবেষণা জার্নাল। বিভিন্ন বিভাগ থেকে গবেষণা জার্নাল প্রকাশিত হলেও নেয়া হয় না শিক্ষার্থীদের কোনো লেখা। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ইবি আবাসিক উল্লেখ থাকলেও ৪৪ বছরে তা পূর্ণতা পায়নি। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৮টি হল, যাতে মাত্র চার হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারে। পরিবহন পুলে ৪৫টি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি এসি কোস্টার গাড়িসহ বাস-মিনিবাস ২২টি, অ্যাম্বুলেন্স ২টি, পিকআপ ২টি। তবে চাহিদার তুলনায় এই আবাসন ও পরিবহন সুবিধা অপ্রতুল। নতুন বিভাগ খোলা হলেও পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব ও সেমিনার লাইব্রেরির সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে নতুন বিভাগগুলো।  অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশনজট থেকে বেরিয়ে এসেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে রয়ে গেছে সেশনজট।

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০