নিজস্ব প্রতিবেদক:ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে ঋণ কারা কোন প্রক্রিয়ায় নিয়েছে, এসব ঋণের যথাযথ জামানত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য সব ধরনের ঋণ নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটির পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ। গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংকটির নতুন পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন ও লুটপাটের অভিযোগে এস আলম ও তার সমর্থিত কর্মকর্তাদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। ফলে ব্যাংকটির এমডিসহ এস আলমপন্থি শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাংকে যেতে পারছিলেন না। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম। তবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহে আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ইসলামী ব্যাংক এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ব্যাংকে পাঁচজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে। তার নেতৃত্বে গতকাল ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভায়।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক স্বতন্ত্র পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ঋণ কারা কী প্রক্রিয়ায় নিয়েছে এবং এসব ঋণের যথাযথ জামানত আছে কি না তা খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য সব ধরনের ঋণের ওপর নীরিক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাংকটির ট্রেজারি বিভাগ কোথায় টাকা ও ডলার বিনিয়োগ করেছে, তাও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া গত সাড়ে সাত বছরে যে জনবল নিয়োগ হয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য পৃথক তিনটি বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। পরিবাগের বাসায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, তাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। তবে আবদুল মান্নান একাই নন, একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও। এরপর তাদের জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়, আর ব্যাংকটি দখল করে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেন গোয়েন্দা সংস্থাটির তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। ক্ষমতায় তখন শেখ হাসিনার সরকার। ওপর মহলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি।
১০ বছর আগেও আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দেশে আনার সেবা দিয়ে গ্রাহক আস্থার শীর্ষে ছিল ইসলামী ব্যাংক। আমানত আর ঋণ বিতরণে ব্যাংকটি এখনও সবার চেয়ে এগিয়ে। ২০১৭ সালে ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ গ্রাহক ছিল এস আলম গ্রুপ, ঋণ ছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, এমডিসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্রুপটির ভালো যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারিতে তাদের সবাইকে সরিয়ে এস আলম গ্রুপই যখন ব্যাংকটি দখল করে নেয়, তখন সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
নিজেদেরই এক গ্রাহককে একেবারে ভিন্ন রূপে দেখতে পান ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চেয়ারম্যান ও এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর নতুন কর্মকর্তা নিয়োগে চাপ দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর সব পর্যায়ে ডিজিএফআইয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের যুক্ত থাকতে দেখা যায়। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে জামায়াত-সমর্থিত হওয়ায় অভিযোগ থাকায় ওই সময়ে কেউ এর প্রতিবাদও করেননি। নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এস আলম গ্রুপ ধীরে ধীরে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করে এবং তাদের নিজস্ব লোক হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার বাসিন্দাদের ব্যাপক সংখ্যায় ব্যাংকে নিয়োগ করতে শুরু করে। এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম পটিয়া অঞ্চলের হওয়ায় ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ওই এলাকার মানুষ বিশেষ সুবিধা পান।
এরপর ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা লুট করে এস আলম গ্রুপ। ঋণ হিসেবে নেয়া এই অর্থ আর ফেরত না আসায় দীর্ঘ সময় ধরে তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের অন্যতম বড় এই ব্যাংক।