ইসলামী ব্যাংকে ডলার কেনাবেচায় কারসাজি বাংলাদেশ ব্যাংকের

রোহান রাজিব: ডলার কেনাবেচায় নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনার জš§ দিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকের কাছে কম দামে ডলার বিক্রি করে একই দিন তা ব্যাংকটি থেকে বেশি দামে কিনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈদেশিক বিনিময় হার নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর পরদিন এ ঘটনা ঘটে। এতে এক দিনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৫৪ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়।
মূলত এস আলমের মালিকানাধীন ব্যাংকটিকে সুবিধা দিতে সদ্য পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নির্দেশে এই নজিরবিহীন ঘটনার জš§ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনেই তা উঠে এসেছে।

জানা যায়, গত ৯ মে ইসলামী ব্যাংক দুটি ডিলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮২ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির জন্য ওই সময় প্রতি ডলার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১১০ টাকা। তবে একই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রতি ডলার ১১৬ টাকা ৪৬ পয়সা দরে আবার দুটি ডিলের মাধ্যমে ৮৫ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষতি হয় ৫৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আইএমএফের পরামর্শে গত ৮ মে ডলারের বিনিময়হার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি ক্রলিং পেগ চালু করা হয়। এ পদ্ধতির আওতায় ডলারের দাম এক লাফে সাত টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়, যা ৯ মে থেকে কার্যকর করা হয়। এই দর থেকে এক টাকা বেশিতে ডলার বিক্রি ও এক টাকা কমে ডলার কেনাবেচার সুযোগ দেয়া হয়। ওই পদ্ধতি কার্যক্রমের দিন ডলারের দাম এক লাফে সাত টাকা বাড়বে জেনে নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে ইসলামী ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কার্যকরের আগের দিনের রেটে (৮ মের রেটে) ডলার বিক্রি দেখানো হয়।

আবার ক্রলিং পেগ কার্যকরের দিনের রেটে সেই ডলার ক্রয় করার সমঝোতায় পৌঁছানো হয়। সে অনুযায়ী কৌশলে ব্যাংকটির কাছে ৮২ মিলিয়ন ডলার বিক্রির ডিলটি আগের দিনের তারিখে দেখানো হয়। কারণ ওইদিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকটি থেকে এই ডিলটির কনফারমেশন পরের দিন (৯ মে) সন্ধা ৬টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশ ব্যাংকের মেইলে পাঠানো হয়। আর ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ লাখ ডলার ক্রয়ের ডিলটি লেনদেন সম্পাদনের ওইদিনই হয়েছে। ওইদিন ডলারের মধ্যবর্তী বিনিময় হার ছিল ১১৭ টাকা।

প্রচলিত নিয়মানুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধীনে পরিচালিত ডিলিং রুম থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়। এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে ওই বিভাগের দুটি শাখা কাজ করে। এর মধ্যে ফ্রন্ট অফিস ডলার কেনাবেচার ডিল সম্পাদন করে লেনদেনের বার্তা তৈরি করে। আর মিডল অফিস সেই বার্তাটি পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের অধীনে পরিচালিত ব্যাক অফিসে পাঠায়। ওই বার্তার আলোকে লেনদেন ঠিকমতো হয়েছে কি না এবং লেনদেনের পর অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ অর্থ থাকল, সেগুলো তদারকি করে ব্যাক অফিস। আলোচ্য লেনদেন দুটি সম্পাদনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ব্যাক অফিসে পাঠানোর পর তাদের নজরে এই অসংগতি ধরা পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ডিল সম্পাদনের পর তা ভ্যালুডেটের মধ্যে ব্যাক অফিসে প্রেরণ করা আন্তর্জাতিক রীতি। আর ডিল যেদিন করা হয় সেদিনই ব্যাক অফিসে প্রেরণ করতে পারলে উত্তম। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আলোচ্য চারটি লেনদেনের মধ্যে দুটি ভ্যালুডেটের মধ্যে ব্যাক অফিসে প্রেরণ করা হয়নি। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাপ্ত ডিলের কনফারমেশন গত ৯ মে ফ্রন্ট অফিস কর্তৃক ইনওয়ার্ড রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার এই ডিলটি সংগঠিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাক অফিস কর্তৃক যে ডিল কনফারমেশনপ্রাপ্ত হয়, তাও ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে ওইদিন বিকাল ৬টা ১৩ মিনিটে পাওয়া গেছে। এ সকল তথ্যের প্রেক্ষিতে বোঝা যায়, ডলার বিক্রির ডিল ডেট ৮ মে হলেও মূলত ডিলটি ৯ মে তারিখে সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিল ডেট আগের দিন দেখালেও মূলত অধিক মূল্যে ডলার ক্রয় করে তারপর কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। একই ভ্যালুডেটের ক্রয়-বিক্রয় ডিল ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার ব্যবহার করার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্ভূত ক্ষতির পরিমাণ ৫৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

এতে আরও বলা হয়, ফ্রন্ট অফিস কর্তৃক ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে ৯ মে তারিখের ভ্যালুডেটে সম্পাদনকৃত দুটি ক্রয় ডিল (ডিলডেট ৯/০৫/২০২৪) এবং দুটি বিক্রয় ডিল (ডিলডেট ০৮/০৫/২০২৪) অনুমোদনের পর তা ওইদিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে মিড অফিস শাখায় প্রেরণ করা হয়। ৮ মে’র ডিলডেটে সম্পাদনকৃত দুটি বিক্রয় ডিল ৯ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে প্রেরণ করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে ফ্রন্ট অফিস শাখা থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এছাড়া ডিলের বিপরীতে (ডিলের ফরোয়ার্ডিং) সহকারী পরিচালক ও চিফ ডিলার ব্যতীত ডিভিশন-১-এর সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত পরিচালক ও পরিচালকের কোনো স্বাক্ষর ছিল না।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, রিজার্ড ম্যানেজমেন্ট অপারেশন ম্যানুয়ালের অনুচ্ছেদ ৩.২.১ ও
৩.২.৩-এর নির্দেশনা মোতাবেক ফ্রন্ট অফিস কর্তৃক ফরম্যাট অনুযায়ী ডিল কনভারসেশনসহ ডিলসিøপ প্রস্তুতপূর্বক তা চেক করার পর মিড অফিস শাখায় প্রেরণ করার বিধান রয়েছে। এছাড়া প্রদত্ত ফরম্যাট অনুযায়ী হেড অব ট্রেজারি (ডিভিশন-১-এর পরিচালক) বরারর উপস্থাপিত প্রতিদিন সম্পাদনকৃত ডিলের বিবরণী-সংবলিত অনুলিপি মিড অফিস এবং ব্যাক অফিস শাখায় প্রেরণের বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই নিয়মে তা পাঠানো হয় না। সর্বশেষ গত ১ এপ্রিল থেকে হেড অব ট্রেজারি বরাবর উপস্থাপিত ডিলের বিবরণী-সংবলিত অনুলিপি এ শাখায় প্রেরণ করা হয়নি। ফলে বিবরণী তৈরিপূর্বক তা মিড অফিস ও ব্যাক অফিসে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যে ব্যাহত হচ্ছে এবং একই সঙ্গে ‘রিজার্ড ম্যানেজমেন্ট অপারেশন ম্যানুয়াল’-এর ব্যত্যয় ঘটছে।

এ বিষয়ে জানতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার মনে নেই। এমন কিছু ঘটছে কি না জানি না।’ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে সদ্য পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০