Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:30 pm

ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনে গ্রাহকের আস্থার প্রতি জোর দিন

শরীফুর রহমান আদিল

গত ৫ জানুয়ারি দেশের বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের উচ্চপর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি।

ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও পরিচালকদের সরে যাওয়াকে পদত্যাগের মাধ্যমে রদবদল বললেও বিভিন্ন গণমাধ্যম একে ‘অপসারণ’ বলে চিহ্নিত করেছে। কেননা যাদের অপসারণ করা হয়েছিল, তাদের মেয়াদ এখনও কমপক্ষে ছয় মাস বাকি ছিল। তাদের সঙ্গে সংবাদকর্মীরা যোগাযোগের চেষ্টা করলে তারা স্পষ্ট করে কিছু বলতে রাজি হননি।

অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বলছে, সরকারের পক্ষ থেকেই চারজনের নাম পাঠানো হয়েছে, যা মঞ্জুর করা ছাড়া কোনো পথ নেই। এ পরিবর্তনের শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালের ২ জুন ৩৩তম সভায়, যাতে নতুন নতুন কোম্পানি তৈরি করে ব্যাংকের স্বতন্ত্র ও শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিবেচনায় ব্যাংকটির রদবদলকে অপসারণ বলাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত। আমরা মনে করি, জনগণের মধ্যে আস্থা জোরদার করার উদ্দেশ্য নিয়েই ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আশা-আকক্সক্ষার কথা চিন্তা করে মিসরের মিটগামার ব্যাংকের আদলে ও মিসরের ফয়সাল ইসলামী ব্যাংক, নাসের সোশ্যাল ব্যাংক ও দুবাই ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে ১৯১৩ সালের কোম্পানি লিমিটেড আইনের অধীনে ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক। বলা যায়, এটি দেশের সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার পৃথিকৃৎ। এটি ৩৬ দশমিক ৯১ শতাংশ স্থানীয় এবং ৬৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ (বর্তমানে ৫২ শতাংশ) বিদেশি বিনিয়োগ। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানত ৬৭ হাজার কোটি টাকা। ৩২ বছরে এর শাখা হয়েছে ৩১৭টি। দেশের নিটওয়্যার খাতের প্রায় ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করে এ ব্যাংক। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ দেয় ইসলামী ব্যাংক। রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ আসে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। ২০১৬ সালে এ ব্যাংকের লাভ দুই হাজার তিন কোটি টাকা। ব্যাংকটি আইএসও সনদপ্রাপ্ত এবং লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের সেরা ১০০০ ব্যাংকের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে।

ব্যাংকের আগের এমডি ও পরিচালকদের সরিয়ে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক সচিব আরস্তু খানকে নিয়োগসহ চারজন নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কী এমন চাপ ছিল যে পুরোনো চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালকদের সরিয়ে দিতে হবে? গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় এ ব্যাংকটির শাখা ভাঙচুরের ঘটনা কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটকিয়ে রাখার খবর পাওয়া গিয়েছিল। তখন না সরিয়ে যখন পরিস্থিতি শান্ত, তখন কেন পুরোনোদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ না করেই অপসারণ করা হলো? যদিও অর্থমন্ত্রী ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের চাপের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কোথায়, তা পরে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরস্তু খানের প্রশংসা করে বলেন, তিনি অভিজ্ঞ। আরস্তু খান যদি আগের চেয়ারম্যান থেকে ভালোই হবেন তবে প্রশ্ন জাগে, তিনি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দায়িত্ব থাকাকালীন ওই ব্যাংকের মুনাফা কেমন হয়েছে? বলা যায়, ভালো চেয়ারম্যান হলে রাষ্ট্রায়ত্ত যেসব ব্যাংক কিংবা প্রতিষ্ঠান ১০ বছর ধরে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের একটিতে নিয়োগ দিলেই লোকসান থেকে রাষ্ট্র বাঁচতো! এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না দিয়ে কেন সর্বোচ্চ মুনাফা হওয়া ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হলো? সরকারি ব্যাংকগুলোতে যে ধরনের কেলেঙ্কারির কথা গণমাধ্যমে প্রায়ই আসে, ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এমনটি শোনা যাবে না তো? অর্থমন্ত্রী এক প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের লভ্যাংশগুলো কোথায় যায় তা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে কি এ কারণেই নতুন এমডি নিয়োগ? এমডি নিয়োগ না করে কি লভ্যাংশ ব্যয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করা যেতো না? অথচ দেশের সবকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই চলে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকসহ সব ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে নতুন চেয়ারম্যান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কেন?

যা হোক, নতুন চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ পাওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাকরি হারানোর যে ভয় কাজ করছে, সেটি তিনি পরিষ্কার করেছেন। ভবিষ্যতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগ নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। ৮ জানুয়ারি ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে না। অন্যদিকে একই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, এবার থেকে এখানে হিন্দুরাও চাকরির সুযোগ পাবে । তবে প্রশ্ন জাগে, সম্পূর্ণ ইসলামী ব্যাংকে কীভাবে অনৈসলামিক ব্যক্তিরা যুক্ত হবেন? আজকে যেসব ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিয়োগ পাবেন, তাদের কি কোনো প্রমোশন হবে না? আর যদি হয়ই, তবে তারা কি কোরআন-হাদিস অধ্যয়ন করে ব্যাংক পরিচালনা করার জন্য নিত্য-নতুন পলিসি বের করবে? নাকি এটা আমার আকাশকুসুম কল্পনা? শরিয়াহ বোর্ডের কি কোনো ক্ষমতা আদৌ থাকবে? ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শাখা এখন যে পদ্ধতিতে (জামাতে নামাজ আদায় ও দারস আলোচনা) পরিচালিত হচ্ছে, হিন্দু কর্মকর্তা উচ্চপদস্ত হলে এ পদ্ধতি থাকবে তো? নাকি বর্তমানে পরিচালিত বিভিন্ন সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যাংকের মতো নামাজ পড়াটা ব্যক্তিগত বা ঐচ্ছিক হয়ে যাবে? আর যদি তা-ই হয় তবে ইসলামী ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করার দাবিটা কি অযৌক্তিক হয়ে যাবে? আর যদি নাম পরিবর্তন না করে এ নামেই চালানো হয়, তবে এর মধ্য দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হবে না তো ?  নতুন এমডি একটি যুক্তিসংগত কথা বলেছেন, এখানে আগে যেভাবে একটি নির্দিষ্ট দলের নেতাকর্মী চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতো, এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে সব দলের লোকদের এ ব্যাংকে প্রবেশের সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে নারীরা আগে থেকেই এ ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। ভবিষ্যতে যারা নিয়োগ পাবেন তাদের ইসলামী ব্যাংকের যে বৈশিষ্ট্য তা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয় হবে। অন্যথায় ইসলামী ব্যাংক তার স্বকীয়তা হারাবে। সর্বোপরি হারাবে তার ঊর্ধ্বগতিতে বৃদ্ধি পাওয়া মুনাফা। নতুন এমডি বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, যে ব্যাংকটির পাঁচ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করার সক্ষমতা রয়েছে, সেখানে দুই হাজার কোটি টাকা মুনাফা সামান্য। সবার আশা থাকবে, নতুন এমডির কথা অনুযায়ী ভবিষ্যতে এ মুনাফা বৃদ্ধি করে মুনাফার অর্থটা সঠিকভাবে ব্যয় করা হবে।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং গত ৫ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী এটাকে নির্দিষ্ট একটি দলের ব্যাংক বলায় জনমনে কিছু প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে আর তা হলো, ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। তার মানে এরা কি সবাই জামায়াতের সমর্থক? অথচ বাংলাদেশে ভোটার সংখ্যা ৯ কোটি ৬২ লাখ। জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই ব্যাংক হিসাব খুলতে হয়, তাহলে বলা যায়, এ ব্যাংকের গ্রাহক সবাই ভোটারÑএ হিসেবে আমার কি বলব জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক সংখ্যা দুই কোটি? একটি ব্যাংকের গ্রাহকই যদি হয় এক কোটি ২০ লাখ, তাহলে এদের সবাই কি জামায়াতের সমর্থক? বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। তা হলো, গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ভোট পেয়েছে মাত্র ৩১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৮৪, যা বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা থেকেও প্রায় ৮৫ লাখ কম। এ ধরনের যুক্তি দেওয়ার পেছনে যুক্তিটা কী? নাকি এর মাধ্যমে জামায়াতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার?

এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের যে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়, সে বিষয়টিকে অবশ্য ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। কেননা ব্যাংকটির মধ্যে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কথা একেবারেই অমূলক নয়। এবার সেই দুর্নাম কিছুটা হলেও ঘুচবে বলে বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসের প্রতিফলনও দেখা গেছে গত রোববার শেয়ারবাজারে এ ব্যাংকের শেয়ারের দামে ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়ে। এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদী। ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সেটি বলা কঠিন। ইতোমধ্যে ৫৫ মিনিটে ৭৫ জনের নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা অবশ্য সমালোচনা করেছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে, সেটিকে সামনে নিয়ে কাজ করতে হলে ব্যাংকের স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে এবং মেধাবীরা যাতে এ ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের আস্থা অর্জনের যে চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছে, তাতে কোনো ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি হয় এমন কোনো কেলেঙ্কারির সৃষ্টি যাতে না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং দেশের সাধারণ মানুষ যে আশায় এ ব্যাংকে হিসাব খোলে, তাতে কোনো ব্যত্যয় যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে ইসলামী ব্যাংক পরিচালিত হবে এটাই প্রত্যাশা।

(মতামত লেখকের নিজস্ব- ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)

প্রভাষক, দর্শন বিভাগ

ফেনী সাউথ-ইস্ট ডিগ্রি কলেজ